পাহাড়ধস তদন্তের সুপারিশ ফাইলবন্দি

ফাইল ছবি
সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫ | ২৩:৪৪
টানা বৃষ্টি হলেই শুরু হবে পাহাড়ধস। ঘটবে প্রাণহানি। চলবে মাইকিং, উচ্ছেদ অভিযান। মামলা হলেও গ্রেপ্তার হবে না কেউ। বাস্তবায়ন হবে না তদন্ত কমিটির একটি সুপারিশও– বর্ষায় চট্টগ্রামের পাহাড়ধস নিয়ে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক আখতার কবীর চৌধুরী। তাঁর এ কথাতে হতাশা থাকলেও পরতে পরতে আছে সত্য।
পাহাড়ধসে ২০১৭ সালের ১৩ জুন চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলায় ১৬৮ প্রাণহানির পর তদন্ত কমিটি হয়েছিল ছয়টি। গুরুত্বপূর্ণ ১৮টি সুপারিশ করে তারা। এর আগে ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে ১২৭ জনের মৃত্যুর পর হয়েছিল পাঁচটি তদন্ত কমিটি। তারা দিয়েছিল ৩৬ দফা সুপারিশ। তবে এসব তদন্ত কমিটির একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন করেনি স্থানীয় প্রশাসন। পরিবেশবিদরা বলছেন, পাহাড় রক্ষায় দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে মৃত্যুর এই ঢেউ আসতে পারে প্রতি বর্ষাতেই।
চট্টগ্রামের পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির তালিকা অনুযায়ী, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ রেলওয়ে, সিটি করপোরেশন, সড়ক ও যোগাযোগ বিভাগ, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম ওয়াসার মালিকানাধীন ২৬টি পাহাড়ে ৬ হাজার ৫৫৮ পরিবারের অন্তত ৫০ হাজার মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ বসত গড়েছে। রাঙামাটি শহরের ৩১, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ২০ এলাকাকে এর আগে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রশাসন। এসব পাহাড়ে আছে অন্তত ২০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ বসতি। রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় প্রভাবশালী ও জনপ্রতিনিধিরা আছে এসব বসতি স্থাপনের নেপথ্যে। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর এসব স্থাপনার দখলদার বদল হয়েছে। তবে দখল থেমে নেই। তাই বর্ষা মৌসুমের শুরুতে প্রতিবছর পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি সভা করলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না। প্রভাবশালীর তৃতীয় পক্ষকে সামনে রেখে পাহাড়ে অবৈধ বসতি স্থাপন করায় তাদের বিরুদ্ধে করা যায় না মামলা। ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদে লোক দেখানো কিছু অভিযান চললেও তদন্ত কমিটির স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে না স্থানীয় প্রশাসন।
এত প্রাণহানির পরও পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে কারা– এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রামের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছর ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাবশালীরাই পাহাড়ে ঘর তুলে নিম্নবিত্তের জন্য ফাঁদ তৈরি করেছে। কম টাকা ভাড়া নিয়ে সেই ফাঁদে পা দেয় দরিদ্ররা।’
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, ‘পাহাড়ধসের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হলে কিছু মন্ত্রণালয়কে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এটা হয় না বলে দীর্ঘমেয়াদে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছে না স্থানীয় প্রশাসন। তবে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি।’
৩৬ সুপারিশ ফাইলবন্দি
চট্টগ্রামে ২০০৭ সালে ১২৭ জনের প্রাণহানির পর স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ৩৬ দফা সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। তবে দেড় দশকে একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি। সুপারিশের মধ্যে ছিল– ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় চিহ্নিতকরণ ও বাসিন্দাদের সংখ্যা নির্ধারণ, স্ব স্ব মালিককে তাদের পাহাড় থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া এবং ফৌজদারি মামলা, ঝুঁকি নিয়ে বাস করা বাসিন্দাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী পুনর্বাসন, পাহাড়ে জরুরি ভিত্তিতে বনায়ন করা, পাহাড়ের পাদদেশে গাইডওয়াল নির্মাণ, পানি নিষ্কাশন ড্রেন ও মজবুত সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, পাহাড়ের পানি ও বালু অপসারণের ব্যবস্থা, যত্রতত্র পাহাড়ি বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ করা, পাহাড়ি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ করা, পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না দেওয়া, মতিঝর্ণা ও বাটালি হিলের পাদদেশে অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করে পর্যটনস্পট করা, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করা ও পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।
কেন কমছে না ঝুঁকিপূর্ণ বসতি
টানা বৃষ্টি হলে পাহাড়ে গিয়ে মাইকিং করে প্রশাসন, খোলে আশ্রয়কেন্দ্র। বৃষ্টি থামার পর ফের সেই পাহাড়ের ভাঁজেই ফিরে যায় মানুষ। ২০১৭ সালের ১৩ জুন পাহাড়ধসে ১৬৮ প্রাণহানির পর গঠিত ছয়টি তদন্ত কমিটির সবাই তাদের প্রতিবেদনে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারীদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের সুপারিশ করে। সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনা, পাহাড়ের ভাঁজে বসতি স্থাপনকারীদের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন না দেওয়া এবং সংরক্ষিত এলাকায় যাতে এভাবে অবৈধ বসতি গড়ে না ওঠে সে ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরকে আরও কঠোর হতে বলে তদন্ত কমিটি। তবে একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন করতে পারেনি প্রশাসন। উল্টো প্রাণহানির পর শুধু চট্টগ্রামের পাহাড়ের পাদদেশে নতুন ঘর উঠেছে ৯ শতাধিক। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজারের হিসাব টানলে এমন ঘরের সংখ্যা অর্ধলাখ ছাড়িয়ে যাবে।
অতিঝুঁকিপূর্ণ ২৬ পাহাড়ে সাইনবোর্ড
জেলা প্রশাসন জানায়, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন। অথচ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশন আদেশ মোতাবেক পাহাড় ও টিলা কাটা বা মোচন বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করতে নির্দেশ দেওয়া আছে জেলা প্রশাসনকে। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অমান্য করলে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুসারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। তবে আদতে তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না স্থানীয় প্রশাসন।
- বিষয় :
- পাহাড়