ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

মিলেমিশে দুই ইজারাদারের সরকারি বালু আত্মসাৎ

মিলেমিশে দুই ইজারাদারের  সরকারি বালু আত্মসাৎ

কটারকোনা বালুমহালে লাল নিশান টানিয়ে জমাকৃত বালু জব্দ করে প্রশাসন সমকাল

কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫ | ০০:০৭

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার মনু নদীর কটারকোনা বালুমহাল ঘিরে চলছে লুটের তাণ্ডব। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান ইজারাদারের সহায়তায় সেই বালু লুটতে তৎপরতা চালাচ্ছেন পূর্বের জন।
প্রশাসনের অধীনে বালুমহালটিতে থাকা প্রায় ২৭ কোটি টাকার বালু সরকারি সম্পত্তি। আগে তোলা হলেও নিয়ম অনুসারে পূর্বের ইজারাদার সেই বালুর মালিকানা দাবি করতে পারেন না। নতুন ইজারাদারের সময় সেটি উত্তোলন করা হয়নি বলে তাদেরও এতে অধিকার নেই। এসব বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে জমাকৃত বালু লোপাটে মরিয়া হয়ে উঠেছেন দুই ইজারাদার।
প্রায় দুই বছর আগে ইজারার মেয়াদ শেষ হলেও সরকারের মোটা অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ওই বালু লোপাটের জন্য তৎপরতা শুরু করেন সাবেক ইজারাদার দীপক দে। তাঁর এই কাজে বর্তমান ইজারাদার নাজমুন নাহার লিপির সহায়তা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
চলতি ১৪৩২ বাংলা সনে ওই বালুমহালের ইজারা পান হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সেলিম আহমদের স্ত্রী নাজমুন নাহার লিপি। আগের ইজারাদারের মতো লিপিও বিশেষ রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে সেখানে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এর আগে সাবেক ইজারাদার কুলাউড়ার দীপক দেও ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে বালুমহালের নিয়মনীতি ভেঙে বেপরোয়া বালু উত্তোলন করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের কেউই সরাসরি কোনো দলের সক্রিয় সদস্য নন।
এদিকে বর্তমান ইজারাদারের কাছ থেকে সহায়তা নেওয়ার পাশাপাশি একটি ব্যবসায়িক অংশীদার গড়ে তুলে আগের জমানো প্রায় সাড়ে ৫ কোটি ঘনফুট বালু থেকে এরইমধ্যে প্রায় ১ কোটি ঘনফুট বালু অবৈধভাবে বিক্রি করা বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে সরকারি বালু নিয়ে অবৈধ তৎপরতা বন্ধে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানান স্থানীয় লোকজ; যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের নির্দেশে গত বুধবার বিকেলে হাজীপুর ও টিলাগাঁও ইউনিয়নের বিভিন্নস্থানে জমাকৃত বালুর স্তূপ চিহ্নিত করে সেখানে লাল পতাকা টানিয়ে সরকারিভাবে জব্দের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। 
জানা গেছে, মনু নদীর কটারকোনা বাজারসংলগ্ন বালুমহাল থেকে সরকার প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। গত ১৪৩০ বাংলা সনে জেলা প্রশাসন থেকে ওই বালুমহাল ইজারা নেন দীপক দে। বালু উত্তোলনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও বিগত সরকারি দলের প্রভাবশালীদের সহায়তায় বালু উত্তোলন চালিয়ে যান দীপক। এ কাজে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতার সম্পৃক্ততার কথা জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
সূত্র জানায়, নদীতীরবর্তী টিলাগাঁও ইউনিয়নের সালন, হাজীপুর ইউনিয়নের কনিমুড়া, হরিচক, সাধনপুরসহ বিভিন্ন স্থানে কয়েক কোটি ঘনফুট বালু জমা করেছিলেন দীপক দে; যার পুরোটা তিনি বিক্রি করতে পারেননি। সরকারি নিয়ম বলছে, ইজারার নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে তোলা বালু বিক্রি কিংবা সরিয়ে না নিলে ওই বালু সরকার পরবর্তীকালে নিলামে বিক্রি করতে পারবে। দীপক দে সেটি না মেনে বর্তমান ইজারাদার নাজমুন নাহারের সঙ্গে যোগসাজশে সেখান থেকে বালু বিক্রি করেছেন। 
নতুন ইজারাদার নাজমুন নাহারের ব্যাপারে জানা গেছে, বালুমহালের রক্ষণাবেক্ষণ, বালু উত্তোলন, পরিবহন, বিপণনসহ যাবতীয় কাজের জন্য কুলাউড়ার ব্যবসায়ী আব্দুল হাছিবকে চলতি বছরের ৮ মে বৈধভাবে আমমোক্তার নিয়োগ করা হয়েছে। একপর্যায়ে তাঁর স্বামী সেলিম আহমদ এবং সাবেক ইজারাদার দীপক দেসহ একটি মহল বালু উত্তোলনে বাধা দিলে আব্দুল হাছিব কুলাউড়া সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন। ওই মামলায় নাজমুন নাহার ও তাঁর স্বামী সেলিম আহমদের বিরুদ্ধে আদালত অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন।
অন্যদিকে বর্তমান ইজারাদারের সহযোগী দীপক দে ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে বালুমহালের কাজে বাধা প্রদানের ব্যাপারে আব্দুল হাছিব নিষেধাজ্ঞা প্রার্থনা করলে আদালত তাদের বিরুদ্ধে আগামী ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তর্বর্তী নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন। গত মঙ্গলবার আব্দুল হাছিব বালুমহালের বিভিন্ন স্থানে নির্দেশনা সংবলিত সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেন। ওই সাইনবোর্ডটি অভিযুক্তদের অনুসারী হাজীপুরের বাসিন্দা সুমন আহমদসহ বেশ কয়কজন গিয়ে উপড়ে ফেলেন। 
বালুমহালে গিয়ে দেখা যায়, নদীর একেবারে তীর ঘেঁষে কয়েকটি স্থানে রাখা হয়েছে বিশাল বালুর স্তূপ। এরমধ্যে উপজেলার হাজীপুর ও টিলাগাঁও ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে আইন না মেনে ১০ চাকার ডাম্পার ট্রাকে অতিরিক্ত বালু বোঝাই করে সরবরাহ করা হচ্ছে; যার কারণে টিলাগাঁও ইউনিয়নের সালন, হাজীপুরের কনিমোড়া, হরিচক ও সাধনপুর এলাকায় সওজ, এলজিইডি, গ্রামীণ সড়কসহ নদী প্রতিরক্ষা বাঁধ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 
অভিযোগের ব্যাপারে দীপক দে জানান, বিভিন্ন জটিলতার কারণে স্তূপ করা বালু সময়মতো সরাতে পারেননি। সেজন্য বর্তমান ইজারাদারের সঙ্গে অংশীদার হয়ে আগের তোলা বালু অন্যত্র নিচ্ছেন। তবে বর্তমান ইজারাদার নাজমুন নাহার লিপির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। 
সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহ জহরুল হোসেন বলেন, আইন অমান্য করে যদি কেউ জব্দকৃত বালু আবার নেওয়ার চেষ্টা করে তবে তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

×