ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সময়ক্ষেপণেই ৪শ কোটি টাকা ক্ষতি সরকারের

সময়ক্ষেপণেই ৪শ কোটি টাকা ক্ষতি সরকারের

সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৫:১৮

তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় ১৬ থেকে ২২ টাকা। কিন্তু সরকারি মালিকানাধীন কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ ৪০ পয়সার কম। অথচ দেশের সবচেয়ে সাশ্রয়ী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে যথাযথ নজর নেই দায়িত্বশীলদের। সংস্কারের অভাবে এখানকার উৎপাদন নেমেছে প্রায় অর্ধেকে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিট থেকে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে ১৩০ মেগাওয়াটের কম। উৎপাদন অর্ধেকে নামায় দেশের মানুষকে এখন বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে। কাপ্তাইয়ের সব ক'টি ইউনিট সচল না থাকায় গত ২ বছর ১০ মাসে সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ক্ষতির বোঝা শেষ পর্যন্ত চাপছে ভোক্তার কাঁধে। বাড়ছে বিদ্যুৎ বিল। বাড়ছে এ খাতে সরকারের ভর্তুকিও।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক সিকান্দার খান বলেন, 'সরকারি মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্র যত বেশি উৎপাদন করতে পারবে তত বেশি সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পাবে জনগণ। সরকারের ভেতরেই একটি চক্র আছে যারা বেশি দামের বেসরকারি বিদ্যুৎ কিনতে ছলচাতুরী করে। এ জন্য বিদ্যুৎ খাতে কমছে না দুর্নীতি। কমছে না সরকারের ভর্তুকিও।' কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এখন উৎপাদন করছে তার সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ। পাঁচটি ইউনিটের স্থলে এখন চালু আছে মাত্র দুটি। তিনটি ইউনিট বন্ধ থাকায় চালু থাকা দুটি ইউনিটকে এখন বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে। এতে তৈরি হচ্ছে ঝুঁকি। আবার হচ্ছে আর্থিক ক্ষতিও।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২ নম্বর ইউনিটটি ওভারহোলিংয়ের (পূর্ণাঙ্গ সংস্কার) জন্য এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ। করোনার কারণে কাজ বন্ধ থাকায় ইউনিটটি আগামী এপ্রিলের আগে চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিট দুটি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ২০১৮ সালে। কিন্তু দরপত্র নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় দুই বছরেও শুরু হয়নি সংস্কার কার্যক্রম। এ জন্য প্রতি মাসে এখন সরকারের ক্ষতি হচ্ছে ১১ কোটি টাকারও বেশি। ২ বছর ১০ মাসে এই ক্ষতির মোট পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।

উৎপাদন চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ২ বছর ১০ মাসে ৪ নম্বর ইউনিটটি ১১ হাজার ২২৮ ঘণ্টা ও ৫ নম্বর ইউনিটটি ১০ হাজার ৮৯ ঘণ্টা চালানো হয়। যান্ত্রিক ত্রুটি থাকায় ইউনিট দুটি থেকে ১৮ কোটি ২৯ লাখ ৬০ হাজার ৮৮৮ ইউনিট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হয়েছে। প্রতি ইউনিট ৪০ পয়সা হিসাবে যার উৎপাদনমূল্য ৭ কোটি ৩১ লাখ ৮৪ হাজার ৩৫৫ টাকা। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানিসহ অনেক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ২২ টাকা দরে ক্রয় করছে। এই দরে কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিটে কম উৎপাদিত হওয়া বিদ্যুতের মূল্য দাঁড়ায় ৪০২ কোটি ৫১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৩৬ টাকা। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিট দুটি সময়মতো সংস্কার না হওয়ায় সরকারকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে বাড়তি গুনতে হয়েছে (উৎপাদন খরচ বাদে) ৩৯৫ কোটি ১৯ লাখ ৫৫ হাজার ১৮১ টাকা।

বর্ষাকালে কাপ্তাই লেকে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জুন-জুলাই-আগস্টে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র সর্বোচ্চ উৎপাদনে থাকে। গত বছরের ৩০ জুলাই পিক সময়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ২১৩ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও চলতি বছরের ৩০ জুলাই উৎপাদন হয়েছে সর্বোচ্চ ১৪৫ মেগাওয়াট। ৩০ আগস্ট আবার উৎপাদন নামে মাত্র ৯০ মেগাওয়াটে। বর্তমানে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন হচ্ছে ১২৫ মেগাওয়াটের মতো। বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলীরা বলছেন, দ্রুত সংস্কার করা না হলে পুরো বিদ্যুৎকেন্দ্রটিই বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হবে। তখন শতকোটি টাকার ক্ষতি ঠেকবে হাজার কোটিতে।

জানতে চাইলে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আবদুজ্জ জাহের বলেন, 'পাঁচটি ইউনিটের মধ্যে এখন দুটি ইউনিট উৎপাদনে আছে। ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিটে জেনারেটরসহ মালপত্র সরবরাহ কাজের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এক ও দুই নম্বর ইউনিট সংস্কার করতে প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হলেও কাজ শুরু হয়েছে দুই নম্বর ইউনিটে। আশা করছি, এটি ওভারহোলিংয়ের কাজ আগামী এপ্রিলে শেষ হবে। আধুনিকায়ন ও সংস্কার কাজ পুরোপুরি শেষ হলে সক্ষমতা অনুযায়ী ফের উৎপাদনে যেতে পারব।'

জানা গেছে, ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিট সংস্কারের ফাইলটি মন্ত্রণালয়ে আছে। সেখান থেকে অনুমোদনের জন্য ক্রয় কমিটিতে যাবে। এ প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ না হলে ক্ষতির অঙ্ক বাড়তে থাকবে ক্রমশ।

নজিরবিহীন সময়ক্ষেপণ

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানাচ্ছে, পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতেই কাপ্তাইয়ে অবস্থিত দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিট সংস্কারের টেন্ডারে অস্বাভাবিকভাবে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। এ জন্য দরপত্র পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে দু'বার। সংশোধনী আনা হয়েছে পাঁচবার। সময় বাড়ানো হয়েছে ছয়বারেও বেশি। এমন সময়ক্ষেপণেই অন্তত ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে সরকারের। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের এই অনিয়ম নিয়ে গত ৭ জুন সমকালে সংবাদ প্রকাশিত হলে তা দৃষ্টিগোচর হয় মন্ত্রণালয়ের। বিষয়টি তদন্ত করে সাত কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয় মন্ত্রণালয় থেকে। কিন্তু মাঝপথে থমকে যায় সে তৎপরতাও।

কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪ ও ৫ নং ইউনিটের জেনারেটরসহ মালপত্র সরবরাহ কাজের জন্য ডিপিএম (সরাসরি ক্রয়) পদ্ধতিতে প্রথম টেন্ডার আহ্বান করা হয় ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি। এতে অংশ নেয় জাপানের কপিরাইটপ্রাপ্ত প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান তোশিবা এনার্জি সিস্টেম অ্যান্ড সলিউশান করপোরেশন। কপিরাইট নিয়মানুসারে এ দুই ইউনিটের জেনারেটরসহ মালপত্র সরবরাহ ও সংশ্নিষ্ট কাজ করতে পারবে শুধু তোশিবা জাপান বা তাদের মনোনীত প্রস্তুতকারক। কিন্তু ল্যান্ডমার্ক নামে বাংলাদেশি একটি প্রতিষ্ঠান আরও কম দামে কাজ করবে বলে অভিযোগ দেয় ক্রয় কমিটিতে। তারা ডিপিএম পদ্ধতির পরিবর্তে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে টেন্ডার দেওয়ার আহ্বান জানায়। তাদের কথায় সাড়া দিয়ে পিডিবি ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফের টেন্ডার আহ্বান করে। এবার দরপত্র দাখিলের সময় নির্ধারণ করা হয় ২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি। তবে এ দরপত্রে দরদাতাকে কর্মক্ষেত্র পরিদর্শনের শর্ত দেওয়া হয়। এ প্রেক্ষিতে ল্যান্ডমার্ক কোম্পানি তাদের মূল প্রতিষ্ঠান মেসার্স এডিসন ইন্ডিয়া ও মেসার্স ভাউওথ চায়না কর্মক্ষেত্র পরিদর্শন করবে বলে আবেদন করে। কিন্তু নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তারা কর্মক্ষেত্র পরিদর্শন না করে আবার সময় বাড়ানোর আবেদন করে। এমন আবেদন বারবার করায় পিডিবি নজিরবিহীনভাবে সময় বাড়ায় মোট ছয় দফা। সর্বশেষ করোনার অজুহাতে আবার সময় বাড়ানোর আবেদন করে তারা। এতে বিপুল পরিমাণের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। বাড়ছে ঝুঁকিও।

আরও পড়ুন

×