ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

অযত্নে পড়ে আছে গণকবর

খন্দকার বাড়ি লাল হয় ৩৭ জনের রক্তে

খন্দকার বাড়ি লাল হয় ৩৭ জনের রক্তে

কুমিল্লার কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় গ্রামের খন্দকার বাড়িতে শহীদের গণকবর দেখাচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শী জহিরুল হক খন্দকার- সমকাল

কুমিল্লা সংবাদদাতা

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৬:০৪

কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় গ্রামে ঘাতকদের উন্মত্ত হত্যাযজ্ঞের দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১১ আগস্ট। সেদিন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ওই গ্রামের খন্দকার বাড়িতে হঠাৎ খবর এলো গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আসছে। মুহূর্তে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। ওই বাড়ির সাদাসিধে কৃষক সরাফত আলী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেদিন পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে আশপাশের বাড়ি ও গ্রামের লোকজনও আশ্রয় নিয়েছিলেন সরাফত আলীর বাড়িতে।

সময় তখন দুপুর প্রায় সাড়ে ১২টা। সরাফত আলী মাঠের কাজ রেখে দুপুরের খাবারের জন্য সাত কৃষি শ্রমিক নিয়ে বাড়িতে আসেন। শ্রমিকদের নিয়ে বাড়ির পুকুরে হাত-পা ধুয়ে ঘরে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ সরাফত আলীর বাড়িতে হানা দেয় পাকিস্তানি সেনারা। আক্রমণ চলে বাড়ির চারদিক থেকে। তখন বাড়ির উঠানে, ঘরে যাকে যেখানে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে তারা। মেশিনগানের গুলিতে একসঙ্গে কয়েক শিশুসহ নিহত হন ৩৭ জন। তাদের মধ্যে সরাফত আলীসহ তার পুরো পরিবার রয়েছে।

সেদিনের ওই গণহত্যা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান সরাফত আলীর মেজো মেয়ে মনুজা খাতুন। যুদ্ধ শুরুর তিন মাস আগে তার বিয়ে হয় পাশের মাঝিগাছা গ্রামে। পারিবারিকভাবে বিয়ে দেওয়া হয় মনুজা খাতুনের মায়ের খালাতো ভাইয়ের ছেলে আবদুল হাকিমের সঙ্গে। স্বামীর বাড়িতে থাকায় বেঁচে যান তিনি। চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি মনুজা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। একাত্তরের ১১ আগস্টের ওই হত্যাযজ্ঞের সময় এলাকা অনেকটা জনশূন্য হয়ে পড়ে। সেদিন বিকেলে লোকমুখে খবর শুনে বাবার বাড়িতে গিয়ে মা-বাবা ও ভাই-বোনের লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখেন মনুজা। গুলিতে ক্ষতবিক্ষত চেহারা বিকৃত হয়ে যাওয়ায় লাশগুলো শনাক্ত করতেও কষ্ট হয় তার।

ওইদিন নিহতদের মধ্যে যাদের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন- কৃষক সরাফত আলী, তার স্ত্রী হামিদা খাতুন, শাশুড়ি জহুরা খাতুন, মেয়ে হাফেজা খাতুন, হাজেরা খাতুন, সালেহা খাতুন, ছেলে জসিম উদ্দিন, নাতি সেলিম মিয়া (হাফেজা খাতুনের ছেলে), খন্দকার বাড়ির সামছুল হক খন্দকার, কৃষ্ণপুর গ্রামের কেরামত আলী, তার ছেলে সৈয়দ আলী, একই গ্রামের আবদুল হাকিম, তার স্ত্রী বেগম আক্তার, ওই গ্রামের চক্ষু মিয়া, আবদুল লতিফ, তার মেয়ে হাসিনা আক্তার, হাসিনা আক্তারের আট মাসের শিশু সাজিদা খাতুন, আবদুল লতিফের অন্য দুই মেয়ে ফিরোজা আক্তার, বকুল আক্তার, ছেলে আজাদ হোসেন ও মাঝিগাছা গ্রামের মনতাজ মিয়া। এই ৩৭ শহীদের মধ্যে সরাফত আলীর বাড়িতে কাজ করতে আসা বিভিন্ন এলাকার সাত কৃষি শ্রমিক এবং অন্য নিহতরা ওই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানিয়েছেন। মঙ্গলবার কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় গ্রামে গিয়ে কথা হয় খন্দকার বাড়ির বাসিন্দা জহিরুল হক খন্দকারের সঙ্গে। তিনি ৩৭ জনকে দাফনের সময় থাকা প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বলে জানান। জহিরুল হক খন্দকার বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে বাড়িটির ওপর পাকিস্তানি হানাদারদের নজর পড়ে। আমার বয়স তখন ১৫-১৬ বছর। আমরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যাই। বাড়ির ৩৭ জনকে হত্যার কথা শুনে ওইদিন বিকেলে আবার বাড়ি ফিরে আসি। এসে দেখি লাশগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেদিন খন্দকার বাড়ির প্রায় ১৫টি ঘর আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল হানাদাররা। পরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে আমরা দুটি গর্ত করি। এক গর্তে নারী এবং অন্য গর্তে পুরুষদের আলাদা করে মাটিচাপা দিই। এই ৩৭ শহীদের ভাগ্যে শেষ গোসল কিংবা জানাজা কিছুই জোটেনি।

ওই এলাকার বাসিন্দা সফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, স্বাধীনতার ৪৯ বছর পার হতে চললেও ওই ৩৭ শহীদের গণকবরটি এখনও সংরক্ষণ হয়নি। শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হাসান মাহমুদের সহযোগিতায় ২০০১ সালের ১৬ জুন একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন আমড়াতলী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত আবদুল করিম। প্রতিবছর ডিসেম্বর এলেই এই গণকবরের খোঁজ নেয় অনেকে। পরে আবার ভুলে যায়।

কথা হয় সেদিন নিহত কৃষক সরাফত আলীর নাতনি (মনুজা খাতুনের বড় মেয়ে) হাসিনা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার মা পরিবারের সবাইকে হারিয়ে একাকী জীবনযাপন করে গেছেন। সেদিন স্বামীর বাড়িতে থাকায় আমার মা প্রাণে বেঁচে যান। দুঃখের বিষয়, আজও ওই ৩৭ শহীদের গণকবরের সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি। গণকবরের জায়গা অনেকে দখল করে ঘর তুলেছেন। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, এখনও ৩৭ শহীদের ভাগ্যে জোটেনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।

এ প্রসঙ্গে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সফিউল আলম বাবুল বলেন, আমরা যাচাই-বাছাই করে ওই গণকবরটি সংরক্ষণের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। তবে জেলার ১১০টি গণকবর সংরক্ষণের বরাদ্দ এলেও এটির বরাদ্দ আসেনি। আশা করছি, পরবর্তী সময়ে ওই গণকবরটি সংরক্ষণ করা হবে।

আরও পড়ুন

×