এমপি বাহারের লোক হলেই মেলে টেন্ডার

ছবি: ফাইল
সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৬:০৪
নিয়ম অনুযায়ী যোগ্য প্রতিষ্ঠানেরই টেন্ডার পাওয়ার কথা। তবে কুমিল্লায় চলছে উল্টো নিয়ম। কাজ পেতে হলে হতে হবে এমপি আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের পছন্দের লোক। এখানে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছে ২০ সদস্যের একটি সিন্ডিকেট। কোনো কাজ যাতে হাতছাড়া না হয়, সেজন্য দপ্তরগুলোতে তাদের বিশেষ নজর থাকে। প্রতিটি দপ্তরে নিজের লোক থাকার বিষয়টি স্বীকারও করেন এমপি বাহার। উন্নয়ন কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্যই ঠিকাদারদের নজরে রাখেন বলে দাবি করেন তিনি। গত বুধবার রাতে এমপি বাহার সমকালকে বলেন, পুরো কুমিল্লাটাই আমার। সরকারের গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প যাতে নয়ছয় না হয়, সেজন্য সবকিছু তদারকি করি। প্রতিটি দপ্তরে আমার নিজস্ব কিছু মানুষ আছে। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করি। মানের সঙ্গে যে ঠিকাদার আপস করে, আমার কাছে তার স্থান নেই। তবে যারা ভালো কাজ করে, তাদের পছন্দ করি।
এক লাখ ১৪ হাজার ৩৩০ ঘনফুট পাহাড় কাটার অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তর যে দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করেছে, সেটির কাজ বেনামে মূলত আপনি করছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে এমপি বলেন, এ অভিযোগ ঠিক নয়। উন্নয়নে যারা বাধা হতে চায়, তারাই এমন অভিযোগ করছে। তাহলে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের কাছে 'এটি আপনার কাজ, আপনি একটি পক্ষ' বলে দাবি করেছেন কেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এমপি হিসেবে সব উন্নয়ন কাজই দেখাশোনা করার দায়িত্ব আমার।
এমপির ভয়ে স্বনামে কথা বলতে রাজি হননি স্থানীয়দের অনেকে। তারা অভিযোগ করেন, কুমিল্লায় টেন্ডারের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ হয় এমপির ইশারায়। সড়ক ও জনপথ, গণপূর্ত অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে তার পছন্দের লোকজনই কার্যাদেশ পাচ্ছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগে সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিমিটেড। কুমিল্লায় শতাধিক ঠিকাদার থাকলেও মোট কাজের এক-চতুর্থাংশ এখন নিয়ন্ত্রণ করছে এই প্রতিষ্ঠান। এটির মালিক নাজমুল হাসান পাখি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স হক এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক। তারা দু'জনই এমপি বাহারের বিশ্বস্ত লোক।
এনামুল হক কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শিল্পবিষয়ক সম্পাদকের পদেও রয়েছেন। সদর দক্ষিণ উপজেলার বড় ধর্মপুর স্কুলপাড়া এলাকায় পিপুলিয়া-লোলবাড়িয়া-রতনপুর-চণ্ডীপুরা-মগবাড়ি সড়ক প্রকল্পের রাস্তা প্রশস্তকরণের কাজ কাগজে-কলমে করছে ওই দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে জনশ্রুতি আছে, এ কাজ বেনামে করছেন এমপি নিজেই। একইভাবে বিভিন্ন দপ্তরের শত শত কোটি টাকার কাজ নামে-বেনামে করা হচ্ছে।
সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পিপুলিয়া-লোলবাড়িয়া-রতনপুর-চন্ডিপুরা-মগবাড়ি সড়কটির অবস্থান কুমিল্লা-১০ নির্বাচনী এলাকায়। ওই এলাকার এমপি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাহাউদ্দিন বাহার কুমিল্লা-৬ (সদর) আসনের এমপি। কুমিল্লার ১১টি সংসদীয় আসনে সরকারের দু'জন প্রভাবশালী মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের ১১ জন এমপি থাকলেও বেশিরভাগ টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন বাহাউদ্দিন বাহার। অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল এবং কুমিল্লা-৯ আসনের এমপি এলজিআরডি মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এসব টেন্ডারের বিষয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না।
এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. আহাদ উল্লাহ বলেন, কাগজে-কলমে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থাকলেও তাদের লাইসেন্স নিয়ে এ কাজ পরিচালনা করছে অন্য কেউ। এমপি নিজে কাজ পরিচালনা করছেন কিনা সে বিষয়টি জানা নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে সড়ক ও জনপথ বিভাগে এখন যত টাকার কাজ হচ্ছে, তার মধ্যে ১০ থেকে ১২ শতাংশ মেসার্স হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিমিটেড করছে বলে জানান তিনি। অনলাইন টেন্ডারে যথাযথ নিয়ম মেনেই কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে বলেও এই কর্মকর্তার দাবি।
একই ঠিকাদারের বারবার কাজ পাওয়ার বিষয়ে ড. আহাদ উল্লাহ বলেন, ১০-১২ জন ঠিকাদার সারাদেশেই সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাজ বেশি পাচ্ছেন। পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে এমনটি হতে পারে।
লালমাই পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণের প্রায় ৪০ কোটি টাকার কাজ ছাড়াও বর্তমানে চলমান থাকা কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক চার লেন প্রকল্পের দুটি ভাগে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার কাজ যৌথ অংশীদারিত্বে করছেন নাজমুল হাসান পাখি। বাবুরহাট-মতলব-পেন্নাই সড়কেও চলছে প্রায় ২২ কোটি টাকার কাজ। এই কাজটি একাই করছে মেসার্স হাসান টেকনো বিল্ডার্স। সড়ক ও জনপথ বিভাগে এমপির হয়ে কাজ তদারকি করেন ইমামুজ্জামান চৌধুরী শামীম, মিজানুর রহমান ইরান ও গোলাম মাওলা।
অন্যান্য সরকারি দপ্তরের কাজও নিয়ন্ত্রণে রাখতে এমপির কিছু লোক আছে। এসব দপ্তরে একের পর এক কাজও পাচ্ছেন এমপির পছন্দের ঠিকাদার। এমপির ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে সাইফুল ইসলাম রনি; শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে জহিরুল ইসলাম রিন্টু, আরফানুল হক রিফাত ও সাদেকুর রহমান পিয়াস; এলজিইডি অফিসে সিরাজ চেয়ারম্যান ও ইকরামুল হক রুবেল; স্বাস্থ্য প্রকৌশলে হাবীবুস আল-আমিন সাদী; পানি উন্নয়ন বোর্ডে নাজমুল করিম সেন্টু, আলী মনসুর ফারুক ও মশিউর রহমান লাভলু; গণপূর্ত অধিদপ্তরে মির্জা মোহাম্মদ কোরাইশী, আবদুল হামিদ ও আনোয়ার কন্ট্রাক্টর এবং জেলা পরিষদে আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদ এমপির হয়ে সবকিছু দেখাশোনা করেন।
এর আগে পাহাড় কাটার অভিযোগে পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করায় পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক শওকত আরা কলিকে মোবাইল ফোনে হুমকি দিয়েছিলেন এমপি বাহার। পরে নিজ অফিসে ডেকে নিয়েও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজনের সামনে হুমকি দেন তিনি। ওই কর্মকর্তাকে ১৫ দিনের মধ্যে কুমিল্লা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বলেন এমপি।
- বিষয় :
- কুমিল্লা
- এমপি বাহার
- টেন্ডার
- সরকারি দপ্তর
- সিন্ডিকেট