ধর্ষণের ‘শাস্তি’ ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা!

প্রতীকী ছবি
রৌমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২১ | ২৩:৫২ | আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২১ | ২৩:৫২
কুড়িগ্রামের রৌমারীতে ধর্ষণের শিকার ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীকে আইনি সহায়তা না দিয়ে অভিযুক্তের ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করে ‘ধর্ষণের বিচার’ করার অভিযোগ উঠেছে দুই ইউপি সদস্যসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। সালিশের সিদ্ধান্ত মেনে না নেওয়ায় উল্টো ওই কিশোরী ও তার পরিবারকে পুলিশি হয়রানির ভয় দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগী পরিবারটি।
গত ১৬ অক্টোবর উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। প্রভাবশালীদের চাপে বর্তমানে আইনি সহায়তা নিতেও আতঙ্ক বোধ করছে ভুক্তভোগী পরিবারটি।
তবে সালিশে ‘ধর্ষণের বিচার’ করা ইউপি সদস্যরা বলছেন, ‘কিশোরীর বিয়ের বয়স না হওয়ায় অভিযুক্তের সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে জরিমানা আদায় করা হয়েছে।’ সালিশে স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন বলে জানান তারা।
নির্যাতনের শিকার কিশোরী জানায়, গত ১৫ অক্টোবর দুপুরে উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের ধনারচর নতুনগ্রামের কছুমুদ্দিনের ছেলে শফি আলম (২০) পাশের একটি বাড়িতে ডেকে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করে। এ সময় কিশোরীর চিৎকারে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসলে খবর পেয়ে শফি আলমের মা সুফিয়া খাতুন দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে নিজ ছেলেকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন এবং উল্টো ওই কিশোরীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। এ ঘটনায় স্থানীয় ইউপি সদস্য (৪ নং ওয়ার্ড) আবু শামা ‘বিচারের’ আশ্বাস দিয়ে ধর্ষণের শিকার ওই কিশোরীকে নিজ হেফাজতে নেন। পরের দিন ( ১৬ অক্টোবর) আলাউদ্দিন নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির বাড়িতে সালিশ অনুষ্ঠিত হয়। রাত ৮টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত চলা ওই সালিশে অভিযুক্ত তরুণ ও ভুক্তভোগী কিশোরীকে হাজির করা হয়। পরে বিচারের নামে ছেলে পক্ষকে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
নির্যাতনের শিকার ওই কিশোরী বলে, ‘আবু শামা ও হযরত মেম্বারসহ সালিশকারীরা বিয়ে দেওয়ার কথা বলে আমাকে শতশত লোকের সামনে হাজির করেন এবং একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন। পরে বিয়ে না দিয়ে তারা বিচারের নামে ছেলে পক্ষকে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন।’
কিশোরীর অভিযোগ, বিচারের নামে জরিমানা আদায়ের সিদ্ধান্ত মেনে না নিতে চাইলে তাদেরকে পুলিশি ঝামেলায় ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। এ নিয়ে মুখ খুললে তাদেরকে বিপদে ফেলা হবে বলেও ভীতি দেখানো হয়েছে। বর্তমানে তারা আইনি সহায়তা নিতে চাইলেও প্রভাশালীদের আচরণে আতঙ্ক বোধ করছে।
নির্যাতনের শিকার কিশোরীর মায়ের অভিযোগ, ‘মেম্বাররা আমাগো হুমকি দিছে, ট্যাকা না নিলে আমার মেয়েরে পুলিশে দিবো। আর ছেলেরে তার বাবার কাছে ফিরায় দিবো। এটা কেমন বিচার! সরমে আমরা মাইনষেক মুখ দেহাবার পারি না। আমাগো সাথে অন্যায় কইরা এহন আমাগোরে পুলিশে দিবো, এ দ্যাশে কী গরিবের বিচার নাই?’
অভিযুক্ত শফি আলমের মা সুফিয়া খাতুন বলেন, ‘সালিশে মাতবররা যে সিন্ধান্ত দিয়েছে, সেটা আমরা মেনে নিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা দিয়েছি। পরে ছেলেকে ঢাকায় পাঠিয়েছি।’
স্থানীয়রা জানায়, ওই সালিশে যাদুরচর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড সদস্য আবু শামা, ১নং ওয়ার্ড সদস্য হযরত আলী, ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল খালেক, ৪নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ স্থানীয় প্রভাবশালীরা উপস্থিত ছিলেন। সালিশে সভাপতিত্ব করেন ১ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল খালেক। ধর্ষণের বিচার করতে সালিশ আয়োজন করা হয়েছে জানিয়ে জরুরী সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেও কোনো প্রতিকার মেলেনি বলে সালিশে উপস্থিত একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সালিশে ধর্ষণের বিচার করার কথা স্বীকার করে যাদুরচর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড সদস্য আবু শামা বলেন, ‘বিচারে শুধু আমি না, অন্য মেম্বার ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতারাও আছিল। এহানে টাকার ছিটাছিটি হইছে। আমি মেম্বার হিসেবে উপস্থিত ছিলাম।’
পুলিশে খবর না দিয়ে ধর্ষণের বিচার সালিশে করা উচিৎ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে এই ইউপি সদস্য বলেন, ‘এটা ভুল হয়েছে। আর হবে না।’
ভুক্তভোগী পরিবারকে পুলিশের ভয় দেখানোর কথা অস্বীকার করে করে এই ইউপি সদস্য বলেন, ‘তারা চাইলে অহনও পুলিশের কাছে যাইতে পারে। আমার কোনো আপত্তি বা জবরদস্তি নাই।’
সালিশে সভাপতিত্বকারী ১ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল খালেক জানান, গ্রামের সবাই মিলে সালিশ করা হয়েছে। মেয়ের বিয়ের বয়স না হওয়ায় বিয়ে না দিয়ে উভয় পক্ষের সাথে কথা বলে ছেলের জরিমানা করা হয়েছে। তারা (ভুক্তভোগী কিশোরী) বিচার না মানলে পুলিশের কাছে যেতে পারে, এতে কারও কোনো আপত্তি নেই বলেও জানান ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ওই নেতা।
ধর্ষণের মতো অপরাধের বিচার করার সালিশে করার এখতিয়ার রয়েছে কিনা, জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘তা নেই। কিন্তু গ্রামের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেই সালিশে গিয়েছিলাম।’
এ বিষয়ে রৌমারী থানার ওসি মোন্তাছের বিল্লাহ বলেন, ‘এ ধরণের ঘটনা মিমাংসার অযোগ্য। আমি এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাইনি। ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেলে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
- বিষয় :
- কুড়িগ্রাম
- রৌমারী
- ধর্ষণ
- ধর্ষণের শাস্তি
- আইনি সহায়তা
- জরিমানা