ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ওসি প্রদীপের ফাঁসি দাবিতে কক্সবাজার আদালত চত্বরে মানববন্ধন

ওসি প্রদীপের ফাঁসি দাবিতে কক্সবাজার আদালত চত্বরে মানববন্ধন

কক্সবাজার অফিস

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২২ | ২৩:১৬ | আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২২ | ০২:০৪

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হবে আজ সোমবার। এই মামলার প্রধান আসামি কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশের ফাঁসি দাবি করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার আদালত চত্বরে মানববন্ধন করে এ দাবি জানান তারা।

টেকনাফের সর্বস্তরের জনসাধারণের উদ্যোগে আয়োজিত এই মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের অভিযোগ, প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ থানার ওসি থাকাকালে নিরীহ লোকজনকে হয়রানি ও নির্যাতন করেছেন। ক্রসফায়ার দিয়েছেন ১৪৫ জন নিরীহ মানুষকে।আজ মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা আছে। তারা চান প্রদীপ কুমার দাশের ফাঁসি হোক।

মানববন্ধনে ব্যানার নিয়ে প্রদীপের ফাঁসি দাবি করে উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারের স্থানীয় সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খানের মা হালিমা খাতুন। তিনি আদালত চত্বরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলেকে ওসি প্রদীপ ছয়টি মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আরও অনেক নিরীহ লোককে হয়রানি নির্যাতন করেছে।’

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। 'লেটস গো' নামে একটি ভ্রমণবিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য প্রায় এক মাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় অবস্থান করছিলেন তিনি। ওই কাজে তার সঙ্গে ছিলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের  ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ।

সিনহা নিহত হওয়ার পর পুলিশ দাবি করেছিল, 'সিনহা তল্লাশিতে বাধা দেন। এ সময় তিনি পিস্তল বের করলে চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে।' এসব বিষয় উল্লেখ করে এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় একমাত্র আসামি করা হয় সিনহার সঙ্গী সিফাতকে। ওই মামলায় সিফাতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর পর সিনহা যেখানে অবস্থান করছিলেন, সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তার ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকেও পুলিশ আটক করে। নুরকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। পরে তারা জামিনে মুক্তি পান।

সিনহা হত্যা মামলার আসামি যারা: আলোচিত এ মামলার ১ নম্বর আসামি পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী। অন্য আসামিরা হলেন- টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল-মামুন, মোহাম্মদ মোস্তফা, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) এসআই মোহাম্মদ শাহজাহান, কনস্টেবল মোহাম্মদ রাজীব ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ। এ ছাড়া পুলিশের করা মামলার তিন সাক্ষী স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজ। সিনহা নিহত হওয়ার আগে যে পাহাড়ে গিয়েছিলেন; নুরুল, নেজাম ও আয়াজ সেই গ্রামের বাসিন্দা। এ ছাড়া টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মা এবং সাবেক এএসআই সাগর দেবও আসামির তালিকায় আছেন। ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১৩ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

আসামির আইনজীবী যা বলেন: মামলায় ওসি প্রদীপের আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত। তার ভাষ্য, 'ওসি প্রদীপ এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত নন। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাকে এ মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এ হত্যার সঙ্গে প্রদীপের সংশ্নিষ্টতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র ও বাদীপক্ষ। ন্যায়বিচার না পেলে উচ্চ আদালতে যাব।'

আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী মহিউদ্দিন খান বলেন, আদালতের কাছে আমরা ন্যায়বিচার পাব, আশা করি। প্রত্যাশিত রায় না হলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

তদন্ত কমিটি ও সুপারিশ: সিনহা হত্যার পর ২০২০ সালের ১ আগস্ট চট্টগ্রামের তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কমিটি মোট ৬৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে দীর্ঘ জেরা করা হয়েছিল। পরে ৫৮৬ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া হয়। ওই ঘটনায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের ভূমিকাকে হটকারী ও অপেশাদারি ছিল বলে উল্লেখ করা হয়।

টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপের সময়কালে ১০৬টি 'বন্দুকযুদ্ধে' ১৭৪ ব্যক্তি নিহত হয়। এ বিষয়েও তদন্ত কমিটি তার কাছে জানতে চায়।

সাক্ষীর ভাষ্য: শামলাপুর চেকপোস্টের কাছে বায়তুন নুর জামে মসজিদ। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে মসজিদের ছাদে অবস্থান করছিলেন মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. আমিন। সিনহার বোনের করা হত্যা মামলায় র‌্যাবের দাখিল করা অভিযোগপত্রের অন্যতম সাক্ষী তিনি। তিনি বলেছেন, ১ আগস্ট ছিল ঈদুল আজহা। ঈদের জামাত, পশু কোরবানি বিষয়ে কেন্দ্রীয় মসজিদের মাইকিংয়ের ঘোষণা শুনতে তিনিসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী মসজিদের ছাদে অবস্থান করছিলেন। ওই সময় এপিবিএনের চেকপোস্টে উচ্চস্বরে কথা শুনলে সেদিকে দৃষ্টি দেন। ওই সময় দেখা যায়, রুপালি রঙের একটি গাড়ির সামনে শামলাপুর ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এসআই নন্দদুলাল। গাড়ির পূর্বে একজন এবং পশ্চিমে ২ জন এপিবিএন সদস্য দাঁড়ানো ছিলেন।

হাফেজ আমিন জানান, তখন লিয়াকত চিৎকার করে গাড়ি থেকে যাত্রীদের বের হওয়ার নির্দেশ দিলে গাড়ির পশ্চিম পাশ থেকে দুই হাত ওপরে তুলে লম্বা চুল থাকা এক যুবক বের হন। লিয়াকতের নির্দেশ পেয়ে এপিবিএনের ২ সদস্য ওই যুবকের হাত ধরে রাখে। লিয়াকত আবারও চিৎকার দিয়ে গাড়িতে থাকা ব্যক্তিকে বের হওয়ার জন্য বলেন। এর পর গাড়ির ড্রাইভিং সিটে থাকা ওই ব্যক্তি হাত ওপরে তুলে গাড়ি থেকে বের হন এবং লিয়াকতের দিকে সামনে একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ান। এ সময়েই কোনো কথা না বলে লিয়াকত পরপর ২টি গুলি করেন।

এ ছাড়া অন্যান্য সাক্ষীর বক্তব্য থেকেও একই রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। লিয়াকতের পর ওসি প্রদীপ এসে সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করেন বলে তারা উল্লেখ করেন।

দুর্নীতির মামলা বাতিল চেয়ে আবেদন: অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে করা মামলা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। গতকাল রোববার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে চট্টগ্রামে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা করেন তৎকালীন সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন। এর পর গত বছর ২৬ জুলাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সবশেষ গত বছর ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ মুন্সী আবদুল মজিদের আদালত প্রদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন।

আরও পড়ুন

×