জেরিন বেঁচে গিয়ে প্রমাণ করল জিন নয়, মানুষই খুনি

বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন জেরিন- সমকাল
মোহন আখন্দ, বগুড়া
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ০৯:৪৮ | আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ০৯:৪৮
বগুড়ার কাহালু উপজেলার দামাই গ্রামে তিন দিনের ব্যবধানে দুজনের মৃত্যুতে ছড়িয়ে পড়ে এর পেছনে জিনের হাত রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা তা বিশ্বাসও করতে শুরু করেছিলেন। এমন সময়ই চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী সেটিকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে। 'কথিত জিনের' আঘাতে দু'দিন অচেতন থাকার পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে ৯ বছর বয়সী জেরিন খাতুন জানিয়ে দেয় প্রকৃত সত্য।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দামাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জেরিন খাতুন জানায়, একজন মানুষই তাকে এবং তার দেড় বছর বয়সী বোন সাবামনির মাথায় আঘাত করেছিল। বসার পিঁড়ি দিয়ে সজোরে করা সেই আঘাতে ছোট বোনের তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়, আর সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
জেরিনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ রেজোয়ান নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি জেরিনের বাবার চাচাতো ভাই।
জেরিনের বাবা জাহাঙ্গীর আলম সমকালকে বলেন, 'যদি আমার বড় মেয়ে বেঁচে না থাকত, তাহলে তাদের মৃত্যুতে জিনের হাত রয়েছে বলে সবাই বিশ্বাস করত। জেরিন বেঁচে আছে বলেই এখন আসল কারণ জানা যাচ্ছে।'
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেরিনের বাবার মামাত ভাই আতাউর রহমান গত জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে নতুন বাড়ি নির্মাণ শুরু করেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ অসুস্থ হন এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি মারা যান। তার আকস্মিক মৃত্যুতে জিনের হাত রয়েছে বলে গ্রামের কিছু মানুষ প্রচার করে। বলা হয়, মসজিদের পাশের জায়গায় বাড়ি না করার জন্য স্বপ্নে আতাউর রহমানকে নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা শোনেননি। উল্টো সেখানকার একটি গাছ যেখানে জিনেরা বাস করে সেটি কাটার কারণে জিন তাকে হত্যা করেছে।
এরপর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সেই আতাউরের কুলখানির বিরিয়ানি খেয়ে বাড়ি ফিরে গাছে ঢিল ছুড়ে বরই পাড়ার সময় সাবামনির মৃত্যু ও জেরিনের সংজ্ঞা হারানোর ঘটনায় জিনের বিষয়টি মজবুত ভিত্তি পায়।
সাবামনির ফুফু আকলিমা বেগম জানান, ১৮ ফেব্রুয়ারি বিকেল পৌনে ৪টার দিকে সাবামনি ও জেরিনকে গাছতলায় পড়ে থাকতে দেখে কেউ একজন চিৎকার দেন। তখন লোকজন এসে দেখেন যে সাবামনি বেঁচে নেই। তবে জেরিনের শ্বাস-প্রশ্বাস রয়েছে। তাকে দ্রুত বগুড়ায় একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়।
মানুষের অপকর্ম: বৃহস্পতিবার দুপুরে দামাই গ্রামে কথা হয় সাবামনির বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনি জানান, জেরিনকে শহরের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করার পরেও অনেকে বলছিলেন জিনের হাত রয়েছে। তাই শহরের কামারগাড়ি এলাকার 'লাখো দাওয়া এক দোয়া চিকিৎসালয়ে' পাঠিয়েছিলেন। ওই কবিরাজ জানান, 'বদ জিন দ্বারা তার মেয়ে বন্দি'। ছাড়ানোর জন্য ৫ হাজার ৫০০ টাকা দাবি করে। এ সময়ই সিটি স্ক্যানে ধরা পড়ে তার মেয়ের মাথার পেছনে আঘাত লেগেছে এবং সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তখন মনে হতে থাকে এটি মানুষের কাজ।
জাহাঙ্গীর বলেন, '২০ ফেব্রুয়ারি জ্ঞান ফেরার পর জেরিন যখন বলে, আমার চাচাতো ভাই রেজোয়ান বসার পিঁড়ি দিয়ে সাবামনি ও তাকে (জেরিন) আঘাত করেছিল। তখন সবকিছু পরিস্কার হয়ে যায়।'
জাহাঙ্গীর আলমের অভিযোগ, সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বিরোধের জের ধরে চাচাতো ভাই রেজোয়ান তার দুই মেয়েকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল।
অন্যদিকে আতাউর রহমানের স্ত্রী নাজিরা বেগম সমকালকে বলেন, 'গত ১২ ফেব্রুয়ারি বাড়ির কাজ করতে গিয়ে একটি ভারী বস্তু পায়ের আঙুলে পড়ার পর আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসকরা জানান, তিনি ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত। এরপর তাকে আর বাঁচানো যায়নি।' তিনি বলেন, 'আমার স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর থেকে গ্রামের সবাই বলত যে তাকে জিনে শাস্তি দিচ্ছে। কিন্তু আমরা তা বিশ্বাস করতাম না। এখন জেরিনের কথায় সব পরিস্কার হয়ে গেছে।'
কাহালু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমবার হোসেন জানান, শিশু সাবামনি হত্যা এবং তার বড় বোন জেরিনকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় রেজোয়ান নামে এক ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেছেন তাদের বাবা জাহাঙ্গীর আলম। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হবে। এছাড়া ময়নাতদন্তের জন্য সাবামনির লাশ উত্তোলনে আদালতে আবেদন করা হবে।