ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সাবেক মন্ত্রী মোশাররফের ভাই বাবরের বিপুল বিত্ত

সাবেক মন্ত্রী মোশাররফের ভাই বাবরের বিপুল বিত্ত

অর্থ পাচার মামলায় ফরিদপুর সদরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ- সমকাল

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা ও ফরিদপুর অফিস

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২২ | ২০:৪৪

পরনে চেকশার্ট। মলিন মুখ। বিষণ্ণ চেহারায় ভয় আর আতঙ্কের ছাপ। সোমবার রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তারের পর এমন অবয়বে খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরের ছবি গতকাল ফেসবুকে ভাইরাল হয়। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ফরিদপুরের আমলি আদালতের মাধ্যমে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। বাবর সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছোট ভাই।

একসময় বাবরের কথায় ওঠবস করত গোটা ফরিদপুর। সর্বশেষ ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। সদর উপজেলার চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন। তবে হাওয়া বদলে গেছে। তাই সাবেক মন্ত্রীর ভাইয়ের হাতে হাতকড়া। মানি লন্ডারিং মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে পারেননি তিনি। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা দেশে-বিদেশে বাবরের অঢেল সম্পদ থাকার তথ্য পেয়েছেন। সেমতে কানাডায় তার পরিবারের এক সদস্যের বাড়িও আছে। যদিও একসময় বাবরের আয়ের একমাত্র উৎস ছিল পোলট্রি মুরগির ব্যবসা। পরে ধীরে ধীরে ভাইয়ের প্রভাব কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।

যে মামলায় বাবর গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাতে ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের বহিস্কৃত নেতা আলোচিত দুই ভাই সাজ্জাদ হোসেন বরকত এবং তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেলও আসামি। দুই হাজার কোটি টাকার সম্পদ অবৈধ উপায়ে অর্জন ও পাচারের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ওই মামলা হয়। পরে সেই মামলার তদন্তে বাবরসহ আরও আটজনের নাম উঠে আসে। কাফরুল থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দায়ের মামলা তদন্ত করে গত বছরের ৩ মার্চ বরকত, রুবেল, বাবরসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। ওই মামলায় বাবরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। পুলিশ বলছে, দীর্ঘদিন বাবর আত্মগোপনে ছিলেন। গোপন তথ্য পেয়ে ওই গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় সোমবার রাত ৩টার দিকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান সমকালকে বলেন, মানি লন্ডারিং মামলায় ১০ আসামির মধ্যে আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখনও দু'জন পলাতক। বাবরকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

মানি লন্ডারিং মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত সিআইডির একজন কর্মকর্তা গতকাল সমকালকে বলেন, মানি লন্ডারিং মামলায় গ্রেপ্তার একাধিক আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে বাবরের নানা অপকর্ম উঠে আসে। মূলত ভাইয়ের প্রভাব কাজে লাগিয়ে ঠিকাদারি কাজ থেকে কমিশন নিতেন তিনি। এ ছাড়া ফরিদপুরকেন্দ্রিক একটি নব্য দুর্নীতিবাজ চক্রকেও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন বাবর।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বাইরে বাবরের সম্পদ থাকার তথ্য তারা পেয়েছেন। কানাডায় তার পরিবারের এক সদস্যের সম্পদের তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া ফরিদপুরে প্রায় ১৫ কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করেছেন বাবর।

পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, বসুন্ধরায় যে বাসা থেকে বাবরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেখানে স্ত্রীসহ বসবাস করতেন তিনি। বাসাটি তার স্ত্রীর নামে নেওয়া। গ্রেপ্তার এড়াতে মোবাইল ফোনে বাবর খুব কাছের লোক ছাড়া কথা বলতেন না। ঘন ঘন বাসা বদলাতেন। যেখানে রাত যাপন করতেন, সেখান থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার আগে মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখতেন।

মঙ্গলবার দুপুরে ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার হলরুমে সংবাদ সম্মেলনে ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) মো. জামাল পাশা জানান, সাবেক এলজিআরডিমন্ত্রীর ছোট ভাই বাবর দীর্ঘদিন ধরে ফরিদপুরের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে টেন্ডার বাণিজ্য করেছেন। চাকরি দেওয়ার নামে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে দেশ-বিদেশে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন।

যারা গ্রেপ্তার :মানি লন্ডারিং মামলায় ১০ জনের মধ্যে যে আটজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের বাকি সাতজন হলেন- শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ছোট ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেল, এলজিআরডিমন্ত্রীর সাবেক এপিএস এএইচএম ফোয়াদ, শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি খন্দকার নাজমুল ইসলাম লেভী, যুবলীগ নেতা আসিবুর রহমান ফারহান, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফাহাদ বিন ওয়াজেদ ফাহিম ও যুবলীগ নেতা কামরুল হাসান ডেভিড। পলাতক আছেন মোহাম্মদ আলী মিনার ও তারিকুল ইসলাম নাসিম। শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি খন্দকার নাজমুল ইসলাম লেভী ও যুবলীগ নেতা আসিবুর রহমান ফারহান বর্তমানে জামিনে।

বাবরের উত্থান :বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর একসময়ে ছিলেন ফরিদপুরের সাবেক সাংসদ ও মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বাবর তার ভাই খন্দকার মোশাররফ হোসেনের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন না। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী ও পরে মন্ত্রী হলে ধীরে ধীরে ভাইয়ের ক্ষমতার বলয়ে ঢুকে পড়েন বাবর।

২০১০ সালের মাঝামাঝি ফরিদপুরের আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন তিনি এবং মন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে ফরিদপুর সদরের বিভিন্ন অফিস-আদালতে প্রভাব খাটাতে থাকেন। তার প্রধান সহযোগী ছিলেন মোশাররফ হোসেনের এপিএস সত্যজিত মুখার্জি, শ্রমিক লীগ নেতা বিল্লাল হোসেন এবং জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মোকাররম মিয়া বাবু। তাদের ছত্রছায়ায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, পাসপোর্ট অফিস, সড়ক বিভাগ, এলজিইডি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে টেন্ডার চলে যায় বাবরের নিয়ন্ত্রণে। এর পর তিনি ২০১৪ সালে বড় ভাই মোশাররফের ক্ষমতা ব্যবহার করে ফরিদপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে যান। আওয়ামী লীগের সবাইকে তার আনুগত্যে আনতে বিভিন্ন কায়দায় নির্যাতন চালাতে শুরু করেন তিনি। ভুক্তভোগীদের মধ্যে আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ ওরফে ক্যাপ্টেন বাবুল, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শওকত আলী জাহিদ, ছাত্রলীগ নেতা মনিরুজ্জামান মনির, অ্যাডভোকেট বদিউজ্জামান বাবুল প্রমুখ।

উচ্চাভিলাষী বাবর এর পর ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পেতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ২০১৬ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আগে 'বাবরকে সাধারণ সম্পাদক দেখতে চাই'- এমন লেখা হাজারো ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুনে ছেয়ে যায় ফরিদপুর শহর। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। তার পর থেকে তিনি মনোযোগী হন অর্থবিত্তের দিকে। মালয়েশিয়ায় একটি বাড়ি রয়েছে তার। সেখানে তার ছেলে থাকে। ফরিদপুরের কৈজুরী ইউনিয়নের বাইপাস সড়কের পাশে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেন তিনি। এ ছাড়া অনেক জমিজমা কিনেছেন তিনি দৃশ্যমান কোনো বৈধ উপার্জন না থাকলেও। নিজ এলাকায় প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করেছেন।

জানা গেছে, ২০১৭ সাল থেকে দলের অভ্যন্তরীণ কারণে ফরিদপুরে বাবর অস্বস্তিতে পড়েন এবং এক পর্যায়ে ফরিদপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের গদি ফেলে রেখেই তাকে ঢাকায় চলে যেতে হয়। পরে একবার ফরিদপুরে ফিরলেও টিকতে পারেননি তিনি। তার পর থেকে ঢাকাতেই থাকতেন বাবর।

২০২০ সালের ১৬ মে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। ১৮ মে এ ব্যাপারে ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন সুবল সাহা। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ জুন ফরিদপুরে বিশেষ অভিযান চালায় পুলিশ। খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ক্ষমতার বলয়ের নিউক্লিয়াসে যারা ছিলেন, তাদের প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখনই মোশাররফ-ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত রুবেল ও বরকতের বিরুদ্ধে সিআইডি অর্থ পাচারের মামলা করে।
এদিকে, খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় ফরিদপুরে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। বিকেলে জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে শহরের আলীপুর মোড় এলাকা থেকে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে শেষ হয়। মিছিল-পূর্ব সমাবেশে বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শামীম হক, পৌর মেয়র অমিতাভ বোস, শহর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মনিরুল হাসান মিঠু, যুবলীগের আহ্বায়ক জিয়াউল হাসান মিঠু, শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক গোলাম মো. নাছির প্রমুখ। পরে মিছিলে আসা লোকজনের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করা হয়।

ফরিদপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শামসুল হক ওরফে ভোলা মাস্টার সমকালকে বলেন, বাবর কখনোই আওয়ামী লীগের লোক ছিলেন না। বড় ভাই মন্ত্রী হওয়ায় তার প্রভাব কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মোশাররফকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি।

এ বিষয়ে ফরিদপুর-৩ আসনের এমপি খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, 'আমার ভাই তো ৭-৮ বছর বয়সী বালক নয়। সে স্বাধীন মানুষ; স্বাধীনভাবে চলাফেরা করেছে। সে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। সে তার মতো করে ব্যবসা করত, রাজনীতি করত। এ নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করার কী আছে?

আরও পড়ুন

×