বাদ যাচ্ছে ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিধান

প্রতীকী ছবি
ফসিহ উদ্দীন মাহতাব
প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২২ | ২০:৫৭ | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২২ | ২০:৫৭
দেড়শ বছর আগের সাক্ষ্য-প্রমাণ আইনে সংশোধনী আনা হচ্ছে। বিশেষ করে ধর্ষণের অভিযোগের বিচারের ক্ষেত্রে নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার ধারাটি বাতিল করতে যাচ্ছে সরকার। আইনের সংশোধনী আনতে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবনা প্রস্তুত করেছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে ধারাটি সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়েছে। পরে এভিডেন্স (অ্যামেন্ডমেন্ট) খসড়া আইন-২০২২ প্রণয়ন করা হয়েছে। সম্প্রতি আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইনের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক মতামত প্রদান-সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশের জন্য সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়েছে। এটি চূড়ান্ত হলে আগামী মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন হতে পারে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ধর্ষণ মামলার বিচারের ক্ষেত্রে নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার ধারা বাতিলের পাশাপাশি সাক্ষ্য আইনের আরও কিছু বিষয়ে সংশোধনী আনা হচ্ছে। পরবর্তী যে কোনো সময়ে সংসদের অধিবেশনে আইনের সংশোধনী বিল উত্থাপন করা হবে।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ধর্ষণ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনে নামে বিভিন্ন নারী সংগঠন। তাদের মতে, ১৫০ বছরের আগের এভিডেন্স (অ্যামেন্ডমেন্ট), ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার ৪ উপধারার ভিত্তিতে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়ে আসছে। এতে ধর্ষণের শিকার নারীকে তার নৈতিক চরিত্র হরণের শিকার হতে হয়। ধর্ষণ মামলায় নারীর চরিত্র ও তার অতীত ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন করা আদৌ যৌক্তিক হতে পারে না। এ জন্য তারা বিতর্কিত ধারাটি বাতিলের দাবি জানান। তারা আরও বলেছেন, ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার ৪ উপধারার ভিত্তিতে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ করা হচ্ছে। আসামিপক্ষের আইনজীবী ধর্ষণের শিকার নারীর নৈতিক চরিত্র হরণ করে যেসব প্রশ্ন করেন, তা আরেকবার ধর্ষণের শামিল। তাই আইনের এই উপধারা বাতিল করতে হবে। এই উপধারা বাতিলের পক্ষে বিচারপতিসহ আইন-সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিরাও সুপারিশ করে আসছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বিতর্কিত উপধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। আইনের খসড়ার সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য চিহ্নিতকরণ ও গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণ, প্রমাণের দায়ভার, অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি ও আদালতের সাক্ষ্য উপস্থাপনসহ অন্যান্য বিষয়ে প্রাসঙ্গিকতা নির্ধারণ করার লক্ষ্যে এভিডেন্স (অ্যামেন্ডমেন্ট)-১৮৭২ আইন প্রণয়ন করা হয়। সাক্ষ্য সম্পর্কিত এরূপ বিধিবদ্ধ একক আইন উপমহাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। ১৫০ বছরে আগে প্রণীত আইনটি বর্তমান সময়ে কার্যকরভাবে প্রাসঙ্গিক হলেও বিচার ব্যবস্থায় ডিজিটাইজেশন হয়েছে। এমন বাস্তবতার নিরিখে এভিডেন্স (অ্যামেন্ডমেন্ট)-১৮৭২ আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। বিদ্যমান আইনে ধর্ষণ মামলার ভিকটিমকে জেরাকালে তার চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করার সুযোগ রয়েছে, যা নারীর জন্য মর্যাদাহানিকর ও আইনের চোখে সমতা নীতি-পরিপন্থি। এমতাবস্থায় বিদ্যমান আইন সংশোধন করে ধর্ষণ মামলার ভিকটিমকে তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা সম্পর্কিত বিধানটি বিলুপ্ত আবশ্যক।
'বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলার বিচারে চারিত্রিক সাক্ষ্যের ব্যবহার'বিষয়ক এক পরামর্শ সভায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, ধর্ষকের চরিত্র কেমন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। কিন্তু ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র জানার জন্য প্রশ্ন করা হয়। তাই এ ধরনের ধারা ও উপধারা বাতিল করতে হবে। তিনি বলেন, ১৫ থেকে ১৭ বছর আগে আইনজীবী থাকাকালে তারা বলতেন- মেডিকেল প্রতিবেদনে ধর্ষণ প্রমাণ না হলে মামলা টেকে না। কিন্তু মেডিকেল প্রতিবেদনে ধর্ষণের কথা নেই- এ ধরনের অনেক মামলায় বিচারক যথাযথ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে শাস্তি দিয়েছেন। আদালত একজনের সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে আসামিকে ফাঁসির সাজাও দিতে পারেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, দেড়শ বছরের আইনি প্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার নারীকে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণের সময় আবারও প্রায় ধর্ষণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। ধর্ষকের ধর্ষণ করার ইতিহাস আছে কিনা বা প্রবণতা নিয়ে প্রশ্ন আসতে পারে। কিন্তু তা হচ্ছে না।