ঢাবির শতবর্ষে আলোচনা সভা
‘গণতন্ত্র এলো ডাকসুর ভোট থেমে গেল’

ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী- সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২২ | ১০:৫০ | আপডেট: ১২ মার্চ ২০২২ | ১০:৫৯
শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘ঢাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন সচল না থাকা দুঃখজনক। আমি ৯ বছর ডাকসুর কোষাধ্যক্ষ ছিলাম, সে সময় দেশে ছিল সামরিক শাসন, তবু ছাত্র সংসদ ছিল। এরপর যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এলো, তখন থেকে ডাকসু নির্বাচনের কার্যক্রম থেমে গেল।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের মাতৃসম। মায়ের মতোই আমাদের লালন-পালন করেছে, শিক্ষিত করেছে। ১০০ বছর ধরে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও নারীশিক্ষার অন্যতম পাদপীঠ আমাদের এ বিশ্ববিদ্যালয়। এর উন্নয়নে অ্যালামনাইদের ভূমিকা নিতে হবে। শুধু অবকাঠামো উন্নয়নের কথা ভাবলেই চলবে না, গবেষণা, প্রকাশনা ও অনুবাদের মতো কাজের দায়িত্বও তাদের নিতে হবে।’
শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত শতবর্ষের মিলনমেলায় ‘বাংলাদেশের পথযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। আলোচনায় অংশ নেন ডাকসুর সাবেক জিএস বেগম মতিয়া চৌধুরী, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, লেখক-রাজনীতিবিদ ইনাম আহমদ চৌধুরী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হামিদা আখতার বেগম, সাবেক এমপি শামসুজ্জামান দুদু এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক রহমত উল্লাহ। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ. কে. আজাদ ও মহাসচিব রঞ্জন কর্মকার। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম মহাসচিব সুভাষ সিংহ রায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার গুণগত মানোন্নয়নে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, পরিমাণগত বিকাশের সঙ্গে গুণগত উৎকর্ষ যাতে সাধিত হয়, সেই দিকে খেয়াল রাখুন।' উচ্চশিক্ষাসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে অনুবাদের গুরুত্ব তুলে ধরে প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ বলেন, 'আমরা মাতৃভাষার মাধ্যমে অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করেছিলাম, সেটা পারিনি। এর কারণ আমরা তেমন বই লিখতে পারিনি, অনুবাদও করতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র অনেকটা পিতৃতান্ত্রিক, চায় সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করতে। বিশ্ববিদ্যালয় মাতৃতান্ত্রিক, চায় সবাইকে মুক্তি দিতে। অতীতে বিভিন্ন সময়ে তাই রাষ্ট্র বার বার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আঘাত করেছে।’
ডাকসুর সাবেক জিএস বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন, যা কিছু গৌরবের তার পেছনে রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, অ্যালামনাইদের ভূমিকা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের যৌক্তিক দাবির আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন।’
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি আগামী একশ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় যাবে, সে বিষয়ে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ভাবার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয়েছে। এখন একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যানও তৈরি করতে হবে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আবাসন সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ভর্তির সময় অবশ্যই ধারণক্ষমতার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।’
লেখক, রাজনীতিবিদ ইনাম আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমান বাংলাদেশের পথযাত্রা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা এক, অভিন্ন ও যুগপৎ।’
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হামিদা আখতার বেগম বলেন, ‘মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রয়োজন ভালো পরিবেশ। ষাটের দশকে যখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি তখন ক্লাসরুমে শিক্ষার্থী পেয়েছি ৩০ থেকে ৪০ জন। ২০০৮ সালে যখন সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হিসেবে ক্লাস নিয়েছি তখন শিক্ষার্থী ১৫০ জন। আই কন্টাক্টও তো হয় না অনেকের সঙ্গে।' তিনি বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, হল সংসদ এখন নেই। এটি কেবল শিক্ষার্থীর ওপরও নির্ভর করে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও সিদ্ধান্তের ব্যাপার আছে।’
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘আজ এই অনুষ্ঠানে অন্তত তিন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়েছেন। ইতিহাসে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চিরভাস্বর, তারাই ইতিহাস পথপরিক্রমা তৈরি করেছেন। পৃথিবীতে এমন বিশ্ববিদ্যালয় খুব কম আছে যেটি জাতিসত্তার উন্মেষ থেকে শুরু করে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে।’ নিজেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন জানিয়ে তিনি গবেষণা বাড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেন্টার অব এপিলেন্স গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন।
সাবেক এমপি শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. রহমত উল্লাহ বলেন, 'শত বছর আমরা পার করেছি। আগামী শত বছর বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে এগিয়ে নিতে অ্যালামনাইদের দায়িত্ব নিতে হবে।’