ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

জনপ্রতিনিধি জসিমের ইরাকে টর্চার সেল!

জনপ্রতিনিধি জসিমের ইরাকে টর্চার সেল!

আতাউর রহমান

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২২ | ০৪:২০ | আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২২ | ০৪:২২

ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার জসিম ফকির। গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে তিনি জনপ্রতিনিধি হন। এর বাইরে এলাকায়তার পরিচয় সার ব্যবসায়ী। কিন্তু আড়ালে তার ভয়ংকর রূপ; পুলিশের খাতায় তিনি মানব পাচারকারী চক্রের হোতা।

গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জসিম ফকির ইরাকে ছোট ভাই জহিরুল ইসলামকে দিয়ে টর্চার সেল পরিচালনা করেন। যেখানে পাচারের পর লোকজনকে আটকে রেখে নির্যাতন করে দেশ থেকে টাকা আদায় করা হয়। ইরাকেই চাকরি দেওয়ার নামে আটকে রেখে নেওয়া হয় মুক্তিপণ। ঢাকায় বসে কৌশলে মুক্তিপণের এই টাকা সংগ্রহ করেন জসিম মেম্বারের শ্যালক মাহবুব হোসেন।

জসিম ফকিরের টর্চার সেলে বন্দি থাকার পর মুক্তিপণ দিয়ে বেরিয়ে আসা এক প্রবাসীর স্ত্রীর করা মামলা তদন্ত করতে গিয়ে এসব তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। এরই মধ্যে জসিম মেম্বার ও তার শ্যালক মাহবুবকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবির গুলশান বিভাগ। তাদের কাছ থেকে ইরাকে নতুন রুটে মানব পাচার থেকে শুরু করে প্রবাসীদের নির্যাতনের নানা তথ্য জানা গেছে।

ডিবির গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান সমকালকে বলেন, জসিম মেম্বার আগে ইরাকে থাকতেন। তখনই তিনি সেখানে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। ২০১৯ সালে তিনি দেশে ফিরে নিজের এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় মানব পাচারে জড়িত একটি চক্রের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। তিনি বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা দালালদের মাধ্যমে বেকার ও অসহায় মানুষদের খুঁজে বের করেন। এরপর ইরাকে আপন ভাই জহিরুল ইসলামের কাছে পাঠান। তিনি বলেন, ইরাকে বেশি বেতনের লোভ দেখিয়ে কম টাকায় মানব পাচার করতেন জসিম ফকির। এরপর সেখানে নিয়ে টাকার জন্য আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও করে তা দেশে স্বজনের কাছে পাঠাত। কখনও কখনও নির্যাতন করে সরাসরি আটক প্রবাসীকে তার স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দেওয়া হতো। এভাবে দেশ থেকে টাকা আদায় করতেন জসিম ও তার শ্যালক।

টর্চার সেল :করোনার কারণে ইরাকে বেকার হয়ে পড়েন প্রবাসী মাইন উদ্দিন। তিনি কাজ খুঁজতে থাকলে ইরাকে থাকা জসিম মেম্বারের গ্রুপের সদস্য শিহাব উদ্দিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। শিহাব তাকে উচ্চ বেতনে চাকরি দেওয়ার নামে দেশটির কারকুর শহরে নিয়ে যান। এরপর টর্চার সেলে টানা ১০ দিন আটকে রেখে টাকার জন্য চলে নির্যাতন। দেশে স্ত্রী ফারজানা আক্তারকে নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে, ফোনে স্বামীর কান্না শুনিয়ে ঢাকা থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা আদায় করেন জসিম মেম্বার। এরপর ১৫ জানুয়ারি তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ডিবির গুলশান বিভাগের এডিসি মো. কামরুজ্জামান সরদার বলেন, প্রবাসী মাইন উদ্দিন মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেলে পুরো বিষয়টি জানিয়ে বাগদাদে বাংলাদেশ দূতাবাসে অভিযোগ করেন। এরপর তার স্ত্রী রাজধানীর মতিঝিল থানায় জসিম মেম্বার ও ইরাকে অবস্থানরত তার ভাই জহিরুল ইসলামসহ চক্রের কয়েক সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তিনি জানান, তারা জানতে পেরেছেন ইরাকে জসিম মেম্বারের টর্চার সেলে সিলেটের সজীব, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদনান, কিশোরগঞ্জের সুলতান ও রুবেলসহ বেশ কয়েকজন জিম্মি রয়েছে। অনেকে দেশে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়াও পেয়েছে।

মাইন উদ্দিনের স্ত্রী ফারজানা আক্তার জানায়, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কয়েকটি নম্বরে তিনি কয়েক দফায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দেন।

মুক্তিপণের টাকা আদায়ে ভিন্ন কৌশল :ডিবি কর্মকর্তারা জানান, জসিম মেম্বার মুক্তিপণের টাকা সরাসরি নিতেন না। তার শ্যালক মাহবুব মতিঝিলসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের নম্বর সংগ্রহ করে তা ইরাকে থাকা সদস্যদের কাছে পাঠাত। সেই নম্বর ফের ইরাক থেকে চক্রের লোকজন ভুক্তভোগী প্রবাসীদের দেশে থাকা স্ত্রী-স্বজনকে দিতেন। এরপর মুক্তিপণের টাকা জমা হলে মাহবুব তা তুলে ভগ্নিপতি জসিম মেম্বারের কাছে পাঠাতেন।

ডিবির গুলশান বিভাগের এডিসি মো. কামরুজ্জামান সরদার বলেন, তারা তদন্ত করে দেখেছেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এসব নম্বর মতিঝিল ও আশপাশের এলাকার। জসিম মেম্বার ও মাহবুব স্বীকার করেছেন, টাকা লেনদেনের প্রমাণ যাতে না থাকে সেজন্য তারা এমন কৌশলে মুক্তিপণের টাকা নিতেন।

ইরাকে চক্রের যারা :ডিবি পুলিশ এখন পর্যন্ত তদন্তে জানতে পেরেছে ইরাকে জসিম মেম্বারের ভাই জহিরুল ছাড়াও এই চক্রে শিহাব, সুলতান ওরফে আলম, হাবিব, শাহেআলম, আক্কাস, বাবুল মোল্লা ও আপন দুই ভাই মমিন ও আকরাম রয়েছে। জসিম মেম্বারের চক্রে থাকা দালালরা প্রথমে লোক সংগ্রহ করে। পরে তাদের মাত্র এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে ঢাকায় অবস্থানরত মিরাজের মাধ্যমে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই পাঠানো হয়। সেখানে তাদের সদস্যরা পাচার হওয়া লোককে গ্রহণ করে নিজেদের ডেরায় বন্দি রাখে। সেখান থেকে সুযোগ বুঝে পাচার করা হয় ইরানে। সেখানেও তাদের লোক রয়েছে। এরপর সেখান থেকে ইরাকের সুলেমানিয়া বিমানবন্দর হয়ে দেশটিতে পাচার করা হয়।

জসিম মেম্বার ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে দাবি করেছেন, মূলত তার ভাই জহিরুল এসব কাজে জড়িত। তিনি শুধু দেশ থেকে কাজগুলো সমন্বয় করেন। বিভিন্ন ব্যক্তি টাকা পাঠালে তা গ্রহণ করেন। গত ১০ বছরে তার ভাই ইরাকে শতাধিক লোক নিয়েছে। তবে লাভের টাকা রাখতে পারেনি, 'আইপিএল খেলে' (ক্রিকেট জুয়া) শেষ করে দিয়েছে।


আরও পড়ুন

×