ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বিচার হয়নি যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ পাকিস্তানির

বিচার হয়নি যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ পাকিস্তানির

প্রতীকী ছবি

ওয়াকিল আহমেদ হিরন

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২২ | ১৪:৫১

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী শেষ হতে চললেও মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যাকারী ১৯৫ চিহ্নিত পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার বিচারের উদ্যোগ নেই। এরই মধ্যে শীর্ষ মানবতাবিরোধী কয়েকজন অপরাধীর বিচারের রায়ে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তবে অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিষিদ্ধ বা বিচার এবং ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার থমকে গেছে। সর্বমহলে এ বিচার নিয়ে সোচ্চার থাকলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইনেই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সেনা কর্মকর্তাদের বিচার সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা। তাদের মতে, ১৯৭৩ সালের আইনটি করা হয়েছিল মূলত যুদ্ধাপরাধী সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য। এরই মধ্যে ওই আইনে দেশীয় কয়েকজন শীর্ষ দালালের বিচার হলেও পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য প্রয়োজন সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত, যা দৃশ্যমান নয়।

এদিকে একাত্তরের গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধে জড়িত ১৯৫ পাকিস্তানি সেনা সদস্যের মধ্যে বর্তমানে কতজন জীবিত আছেন, তা কারও জানা নেই। কে কোথায় আছেন, সেটারও সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের হাতে নেই। এমন কী বেসরকারি সংস্থা বা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা থেকেও এর সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রকাশিত বিভিন্ন বই ও সংবাদপত্র এবং গবেষণায় পাওয়া খসড়া প্রস্তুত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

তদন্ত সংস্থা জানিয়েছে, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও বিদেশি দূতাবাস থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে কয়েক বছর আগে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। সেটা ওই অবস্থাতেই পড়ে আছে। জানা গেছে, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাজাকারের শিরোমণি গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ অন্য যুদ্ধাপরাধীদের মামলার তদন্ত ও রায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন এবং জামায়াতের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা সংরক্ষণও করা হয়েছে।

বিচার ও তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, তারা ভিনদেশি নাগরিক। তাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের সমর্থন নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। যেখানে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের বিষয়ে নীতিগতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। সেখানে ভিনদেশি এই চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনেকটাই অনিশ্চিত।

সরকারের সংশ্নিষ্টরা জানায়, ওই ১৯৫ জনের মধ্যে কে-কে জীবিত বা মৃত তা জানা নেই। তবে ধারণা করা হচ্ছে, স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে তালিকাভুক্ত ১৯৫ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার মধ্যে অনেকেই মারা গেছেন। সঠিক তথ্য পেলে জীবিত অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদেরই শুধু বিচার হবে। প্রয়োজন হলে পাকিস্তান হাইকমিশনের সাহায্য চাওয়া যেতে পারে।

তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক এম সানাউল হক বলেন, পাকিস্তানি ১৯৫ জনের মধ্যে কতজন জীবিত আছেন, সেটা অজানা। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের তথ্য ও নথিপত্র সংগ্রহ করতে কয়েক বছর আগে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এরপর আর অগ্রগতি নেই। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের বিচার একটি গুরুত্বপূর্ণ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রকাশ্যে এই বিচার শুরু করা উচিত।

জানা যায়, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে অভিযুক্ত ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দি সেনাকে শর্তসাপেক্ষে পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। পাকিস্তান সে সময় অঙ্গীকার করেছিল, দেশে নিয়ে ওই যুদ্ধবন্দিদের বিচার করবে। বাংলাদেশ স্বাধীনের ৫০ বছরেও সে অঙ্গীকার রাখেনি পাকিস্তান।

বিচারে বাধা নেই: পাকিস্তানি ১৯৫ সেনা কর্মকর্তাকে সেই দেশে ফেরত পাঠানো হলেও বিচারে কোনো আইনি বাধা নেই বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইনে পাকিস্তানি ১৯৫ সেনা কর্মকর্তার যুদ্ধাপরাধের বিচার করা সম্ভব। তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার করা যেতে পারে। তিনি বলেন, বিদেশি যুদ্ধাপরাধের সংখ্যা মূলত দেড় হাজারের মতো। শিমলা চুক্তির পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট অঙ্গীকার করেছিলেন, ১৯৫ জনের বিচার করা হবে। সে ওয়াদা রক্ষা করেনি পাকিস্তান সরকার। শুধু প্রতীকী নয়, সঠিক তথ্য নিয়ে তাদের বিচার করা উচিত।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক শাহরিয়ার কবির বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার ও চিহ্নিত পাকিস্তানিদের বিচার শুরু করতে পারলাম না। বয়সের কারণে যুদ্ধাপরাধীরা অনেকেই মারা যাচ্ছে। সাক্ষীরাও চলে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কী জবাব দেবে সরকার।

সেই ১৯৫ জন: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণায় গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত হিসেবে প্রথমে চিহ্নিত করা হয়েছিল পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর ৪০০ কর্মকর্তাকে। ১৯৭২ সালের জুলাই নাগাদ বাংলাদেশ সরকার এ সংখ্যা কমিয়ে আনে ১৯৫-এ।

তালিকাভুক্ত পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার মধ্যে একজন ছিলেন লে. জেনারেল। এ ছাড়া পাঁচজন মেজর জেনারেল, ২০ জন ব্রিগেডিয়ার, পাঁচজন কর্নেল, ৩৯ জন লে. কর্নেল, ৮১ জন মেজর, ৪১ জন ক্যাপ্টেন ও দু'জন লেফটেন্যান্ট ছিলেন। অন্যরা বিমান ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তা। তালিকা অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের ঘটনাগুলোর নীলনকশা প্রণয়ন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেয় ৬৮ জন। জেনেভা কনভেনশনসহ আন্তর্জাতিক সব যুদ্ধনীতি লঙ্ঘন করে সরাসরি গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগে অংশ নেয় ১১৮ জন। ব্যাপক গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল ১৪ জন।

আরও পড়ুন

×