ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ

জেলা পরিষদও গেল আমলাদের হাতে

জেলা পরিষদও গেল আমলাদের হাতে

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২২ | ১৫:০০

জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানরা পাঁচ বছর দায়িত্বে থাকলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে পাননি কাজের তেমন সুযোগ। উপমন্ত্রীর পদমর্যাদাসহ তাদের সব দাবিই রয়ে গেল অধরা। হঠাৎ জেলা পরিষদ ভেঙে দেওয়ায় কাজের নূ্যনতম স্বীকৃতি নিয়েও বাড়ি ফেরা হলো না। একরকম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বুকে পুষে চেয়ার ছেড়েছেন নির্বাচিত পরিষদ চেয়ারম্যানরা। তবে সংশ্নিষ্ট অনেকেই মনে করেন, এই জেলা পরিষদের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে সরকারি দলের বর্ষীয়ান নেতাদের কিছু ক্ষেত্রে 'পুনর্বাসন' করা হয়েছে। পাশাপাশি পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদেও ছিলেন প্রশাসনের পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা।

সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যানদের কেউ কেউ বলেছেন, জেলা পরিষদের মাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মীরা উপকৃত হয়েছেন। তারা দ্রুত নতুন নির্বাচনও দাবি করেছেন। গত ৬ এপ্রিল জাতীয় সংসদে জেলা পরিষদ বিল পাস হয়। পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার কারণে গত রোববার ৬১ জেলা পরিষদ ভেঙে দেওয়ার গেজেট প্রকাশ করা হয়। ওই গেজেটে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে (উপসচিব) নতুন প্রশাসক না বসানো পর্যন্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রশাসক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত এ আমলারাই জেলা পরিষদের দায়িত্বে থাকবেন। যে কোনো ব্যক্তিকে ১৮০ দিনের জন্য প্রশাসক বসানোর সুযোগ রাখা হয়েছে সংসদে পাস হওয়া আইনে। এ ছাড়াও মূল আইনে জেলা পরিষদের ভোটার তালিকা প্রণয়নের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকলেও সংশোধিত আইনে নির্বাচন কমিশনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, জেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটার তালিকা নিয়ে আবারও জটিলতা তৈরি হতে পারে। এ কারণে নির্বাচনও আটকে যেতে পারে।

তবে অনির্বাচিত প্রশাসক বসানোর সরকারের এই সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি অসাংবিধানিক বলে আখ্যায়িত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এই আইনের সংশোধনের প্রস্তাব পাসের আগে সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, বিএনপিসহ একাধিক দলের সংসদ সদস্যরা প্রশাসক বসানোর প্রস্তাবকে সংবিধানবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

সমকালের সঙ্গে আলাপকালে একই ধরনের মত দিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, 'অনির্বাচিত প্রশাসক মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা অসাংবিধানিক।' তিনি আরও বলেন, "যে যুক্তিতে তিন মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক, একই যুক্তিতে স্থানীয় সরকারে ১৮০ দিনের জন্য অনির্বাচিত প্রশাসকও অসাংবিধানিক। কারণ সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে- 'আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।' একইভাবে সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে আরও স্পষ্ট করে বলা আছে- 'প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র এবং প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হইবে।' এর পরও সরকারের তরফে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনোভাবেই সংবিধানসম্মত নয়।"

স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ গতকাল রাতে সমকালকে বলেন, 'জেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে হবে। স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই এতে নিয়োগ পাবেন। প্রশাসক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা দায়িত্বে থাকবেন। নির্বাচনের জন্য নতুন ভোটার তালিকা জেলা প্রশাসকরা তৈরি করবেন। কারণ, এখানকার ভোটার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধিরা হওয়ায় ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা সহজ।' এদিকে সারাদেশের ৬১ জেলা পরিষদের সদস্যরা অনির্বাচিত প্রশাসক বসানোর তীব্র বিরোধিতা করে বলেছেন, তারা আশা করছেন দ্রুত সময়ে নির্বাচন হবে এবং জেলা পরিষদ পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে চলে আসবে। তাদের শঙ্কা, আইনে যে কোনো ব্যক্তিকে প্রশাসক বসানোর সুযোগ থাকলেও বেশিরভাগ জেলায় আমালদেরই প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।

একাধিক জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, এটা আমলাদেরই কারসাজি। তারা জনপ্রতিনিধিদের কোনো তোয়াক্কাই করছেন না। তারা যা খুশি তা করছেন। স্থানীয় সরকার বিভাগ যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, তা চেয়ারম্যানদের জন্য অপমানজনক।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সাদেক কুরাইশী বলেন, 'জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমলা। আবার যদি প্রশাসকও আমলা নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে পুরো জেলা পরিষদ আমলানির্ভর হয়ে যাবে। রাজনীতিবিদদের কোনো জায়গা থাকবে না।' তিনি বলেন, 'সীমিত বরাদ্দে জেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা অনেক উন্নয়ন কাজ করেছে। চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা ও অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো হলে জেলা পর্যায়ে আরও উন্নয়ন হতো।'

সদ্য বিলুপ্ত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফোরামের সদস্য সচিব ও পিরোজপুর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন মহারাজ অনেক অসন্তোষের কথা জানান। তিনি বলেন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদের কোনো পদমর্যাদা নির্ধারিত নেই। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারের পাশাপাশি চেয়ারম্যানের পদমর্যাদা না থাকায় বিভিন্ন কাজে দেখা দেয় সমন্বয়হীনতা। জাতীয়, সামাজিক বা সরকারি অনুষ্ঠানে তাদের পাশে বসতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

পাঁচ বছরের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে মহিউদ্দিন মহারাজ জানান, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার কারণে স্থানীয় রাজনীতিতে তার সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। দলীয় নেতাকর্মীরাও উপকৃত হয়েছেন। দলীয় রাজনীতিতে তিনি ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছেন। তাই আগামীতে পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদেও তিনি প্রার্থী হবেন।
জেলা পরিষদ ভেঙে দেওয়ার পর নতুন দায়িত্বভার গ্রহণকারী ঠাকুরগাঁও জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রামকৃষ্ণ বর্মণ বলেন, 'স্বাভাবিক নিয়মেই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা এখন জেলা পরিষদের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা পেয়েছেন। আগে আর্থিক ক্ষমতাটা যৌথ সইয়ে হতো।'

সিলেট জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সন্দ্বীপ কুমার সিংহ বলেন, 'প্রশাসক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা জেলা পরিষদের দায়িত্ব পালন করবেন। সে হিসেবে আমি দায়িত্ব বুঝে নিয়েছি।'
বিগত পাঁচ বছরে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে অনেক স্থানেই সরকারি দলের বর্ষীয়ান নেতারা ছিলেন। বগুড়া জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ডা. মকবুল হোসেন আবারও এই পদে পেতে আগ্রহী। এখন তার বয়স ৮৮ বছর। এদিকে সিলেট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লুৎফুর রহমান দায়িত্ব পালনকালে সাড়ে চার বছরের মাথায় গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর মারা যান।
রাজশাহী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার অবশ্য ফের চেয়ারম্যান হতে আগ্রহী নন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা মাহবুব জামান ভুলুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে। তিনি জানান, এই পদের কোনো স্ট্যাটাস নেই, কোনো অর্গানোগ্রামও নেই। পাঁচ বছরের মেয়াদকাল তার খুব একটা ভালো লাগেনি। চেয়ারম্যান হিসেবে যতটা সম্মান তিনি আশা করেছিলেন, তা পাননি।

বরিশালের জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মইদুল ইসলাম পাঁচ বছরে মেয়াদে অনেক চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করলেও তা কেমন ছিল বলতে অস্বীকৃতি জানান। স্থানীয় রাজনীতিতে অনেক চাপের বিষয়ে ইঙ্গিত করে তিনি জানান, তিনি যে প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেছেন তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। নীলফামারীর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন বলেছেন, পরিষদে যারা দলীয় প্রতিনিধি ছিলেন স্থানীয় রাজনীতিতে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে তারা অনেক এগিয়েছেন।


আরও পড়ুন

×