ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

জামদানি: বাড়ছে চাহিদা, কমছে কারিগর

জামদানি: বাড়ছে চাহিদা, কমছে কারিগর

ডেমরা কামারগোপ এলাকায় জামদানি দেখাচ্ছেন এক দোকানি- সমকাল

সাজিদা ইসলাম পারুল

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২২ | ২১:১৪ | আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২২ | ২১:১৪

পোনামাছ, বড় ফুল, তেরছা, বুটিদার, ঝালর, পান্না হাজার, ফুলওয়ার, তোরাদার- এমন নানা নকশায় জামদানি তৈরিতে বছরজুড়েই ব্যতিব্যস্ত থাকেন শীতলক্ষ্যা নদীতীরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামের বয়নশিল্পীরা। কারণ বাংলা নববর্ষ, ঈদ, পূজাসহ সব উৎসব-পার্বণেই বাঙালি নারীর পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে জামদানি শাড়ি।

এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ঈদ উপলক্ষে ভোরেই বেচাকেনা শুরু হয় ডেমরা কামারগোপ এলাকার হাটলাগোয়া 'ডেমরা তাঁত জামদানি ঘরে'। আট-নয়জন কর্মচারী নিয়ে হিমশিম খান এ দোকানের কর্ণধার আবদুল করিম। কখনও কখনও দূর শহরের ক্রেতার ফোনে মাঝরাতেও দোকান খুলতে হয় বলে জানান তিনি। শুধু করিমের দোকানেই নয়, এখানকার চাঁদ জামদানি হাউস, নকশি জামদানি, ময়নামতি জামদানি হাউস ও ঢাকা জামদানি শাড়িঘরেও ধুম পড়েছে বেচাকেনার।

'জামদানি' বাংলার এক অনবদ্য সাংস্কৃতিক নিদর্শন। রংবেরঙের সুতা আর প্রধানত প্রকৃতিনির্ভর গ্রামীণ নকশায় বয়নশিল্পীদের সুনিপুণ হাতে নান্দনিক রূপ ও বৈচিত্র্যের এক অনবদ্য সৃষ্টিই জামদানি। এ যেন সুতায় লেখা প্রকৃতির কবিতা।

ডেমরা, গন্ধপুর, মৈকুলী, আমগাঁও, বরগাঁও, তালতলা, ঢেকুর, নোয়াপুর, মদনপুর, মানসুরাবাদ ও তারাব গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, ঈদ সামনে রেখে জামদানি শাড়ির কারিগররা দিন-রাত ব্যস্ত সময় পার করছেন। গ্রামগুলোতে আনাগোনা বেড়েছে মহাজন ও খুচরা ক্রেতাদের। এসব গ্রামে কারিগরদের মধ্যে ৭০ ভাগই নারী। মহাজনদের অর্ডার অনুযায়ী তারা কাজ করছেন। শাড়ি তৈরি হয়ে গেলে বিক্রির জন্য সরাসরি নিয়ে যাচ্ছেন জামদানি হাটে। আবার কেউ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীদের অর্ডারের পণ্য কুরিয়ারেই পাঠিয়ে দিচ্ছেন।

গত শনিবার ডেমরা হাটসংলগ্ন দোকানগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা তৈরি শাড়ি পাইকারদের বুঝিয়ে দিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ঈদে এ শাড়ির চাহিদা বেশি থাকায় অনেক কারিগর তাদের পুরো বছর ধরে তৈরি করা শাড়ি জমিয়ে রাখেন। এ মাসে এসে সেগুলো বিক্রি করেন যতটুকু সম্ভব বেশি দামে। এ বাজারে সুতা, হাফসিল্ক্ক জামদানি (যার আড়াআড়ি সুতা রেশমের) ও ফুল কটন জামদানি (যা পুরোপুরি তুলার সুতায় তৈরি) পাওয়া যায়। যার দাম তিন হাজার ৫০০ থেকে ৪০ হাজার টাকার মধ্যে। জামদানির নকশার ধরনের ওপর ভিত্তি করেও দাম নির্ধারণ করা হয়। আবদুল করিম বলেন, 'সাধারণ সময়ে এ দোকানে প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে ছয় হাজার পিস শাড়ি বিক্রি হয়।

রোজার ঈদে বিক্রি আরও বাড়ে। ক্রেতাদের মধ্যে অনলাইনে যারা বিক্রি করেন, তাদের সংখ্যাই বেশি।'

রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা এলাকার আশপাশের গ্রামে তৈরি হয় জামদানির নকশায় সুতার শাড়ি। নিম্ন আয়ের ক্রেতারা এখান থেকেই কিনে থাকেন পোনামাছ ও বড় ফুলের নকশার জামদানি। এ উপজেলার মানসুরাবাদ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি ঘরে জামদানির নকশা তুলছেন কারিগররা। এখানে জামদানি তৈরি হয় মেশিনে। এসব জামদানির দাম ৯০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকার মধ্যে। আর তালতলায় মেলে তাঁতের জামদানি।

তালতলার বয়নশিল্পী মিজানুর রহমান জানান, তালতলার তাঁতে মূলত রেশমের জামদানি তৈরি হয়। মাটির নিচে তৈরি তাঁতে শাড়ির দুই পাড়ে দু'জন লোক বসতে হয়। সপ্তাহভর কিংবা ডিজাইনভেদে কয়েক মাসও কাজ করেন তারা একেকটি জামদানি তৈরিতে। ফলে তাঁতের জামদানির দাম অনেক বেশি এবং এগুলো টেকসই হয়। এখানকার জামদানি চার হাজার থেকে কারুকাজের ওপর ভিত্তি করে লাখ টাকা দামেরও হতে পারে বলে জানালেন কারিগর মুনির।

অনলাইনে বেচাকেনা: করোনাকালীন ঘরবন্দি জীবনে 'শ্রীময়ী' নামে অনলাইন শপ গড়ে তুলেছেন কর্ণধার চিত্রা কর্মকার। তিনি বলেন, এখানে ঐতিহ্যবাহী সব নকশার জামদানি পাওয়া যায়। বেশিরভাগই তাঁতের জামদানি। নিজস্ব কারিগর দিয়ে তৈরি করায় গুণে-মানে সেরা। দামও হাতের নাগালের মধ্যেই। শাড়ির পাশাপাশি জামদানি পাঞ্জাবি ও সালোয়ার-কামিজও এবার ভালো বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি।

কয়েক বছর ধরে ফেসবুক কমার্সের (এফ-কমার্স) ব্যাপক প্রসার ঘটায় অনলাইনে জামদানি বিক্রির পরিমাণ বেড়ে গেছে। একাধিক বিক্রেতা জানান, নারায়ণগঞ্জ থেকে জামদানি শাড়ি-থ্রিপিস-পাঞ্জাবি নিয়ে সেগুলো অনলাইনে দ্বিগুণ লাভে বিক্রি করেন পেজ মালিকরা।

কারিগর সংকটে জামদানি: শ্রমের ন্যায্যমূল্য বা ভালো মজুরি না মেলায় নতুন করে আর কেউ জামদানি শাড়ি তৈরির পেশায় আসছেন না বলে জানালেন এ শিল্পের ব্যবসায়ীরা। গাউছিয়ার ফাহিম জামদানি হাউসের কর্ণধার ফাহিম জানান, আগে মানসুরাবাদসহ আশপাশের গ্রামে প্রায় ৭০০ জনের মতো কারিগর ছিলেন। বর্তমানে তা নেমে এসেছে ২৫০ থেকে ৩০০-তে। নারায়ণগঞ্জের অন্যান্য গ্রামেও প্রায় একই অবস্থা। কারিগররা জানান, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হলে এ পেশায় থাকা আর সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন

×