ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

ছিটমহল বিনিময়ের ৭ বছর পূর্তি আজ

বঞ্চনার গ্লানি ভুলে এগিয়ে চলা

বঞ্চনার গ্লানি ভুলে এগিয়ে চলা

শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর দাসিয়ারছড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকা সমকাল

মমিনুল ইসলাম মঞ্জু, কুড়িগ্রাম ও শাহিনুর রহমান শাহিন, ফুলবাড়ী

প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২২ | ০১:০২

দেশের উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত হওয়ায় পাল্টে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর দুঃখভরা জীবনের ইতিহাস। মুছে যাচ্ছে দীর্ঘ ৬৮ বছরের নাগরিকত্বহীন অবরুদ্ধ জীবনের গ্লানি আর বঞ্চনার কালিমা। অন্ধকার অর্ধশতাব্দী পেছনে ফেলে এখন শুধুই আলোর অভিমুখে এগিয়ে চলা।

আজ রোববার ছিটমহল বিনিময়ের সাত বছর পূর্তি। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতের পর থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল ছিটমহল। এর ফলে ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর আয়তনের ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও পঞ্চগড় জেলায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ছিটমহলগুলোর ৩৭ হাজার ৫৩৫ জনকে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের ১২টি ছিটমহলের ৭ হাজার ৭৪৭ জন বাংলাদেশের নাগরকিত্ব পান।

ছিটমহলগুলোর মধ্যে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ারছড়া সবচেয়ে বড়। দাসিয়ারছড়ার আয়তন ১ হাজার ৬৪৩ দশমিক ৪৪ একর। এখানকার ৬ হাজার ৫২৯ জন অধিবাসী বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পেয়েছেন। ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর দাসিয়ারছড়া সফরে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন তিনি এ অঞ্চলের অধিবাসীদের উন্নয়নে সবকিছু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উন্নয়ন কাজগুলো একে একে বাস্তবায়িত হওয়ায় বদলে গেছে দাসিয়ারছড়ার চালচিত্র। এজন্য খুব খুশি এখানকার অধিবাসীরা।
অথচ বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে এই জনপদে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল যাচ্ছেতাই। নদী পারাপারে নিজেরাই তৈরি করেছিলেন সাঁকো। ছিল না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নাম ও পরিচয় গোপন করে বাইরের কোনো স্কুল-কলেজে ভর্তি হয়ে দুরুদুরু বুকে চলত লেখাপড়া। চিকিৎসাসেবার বালাই ছিল না। জমির মালিকানার বৈধ কোনো কাগজপত্রও না থাকায় জমি বেচাকেনা করতে হয়েছে মুখে মুখে। বিয়ে হয়েছে ধর্মীয় বিধান মোতাবেক। রেজিস্ট্রি বলে কিছু ছিল না। এমনকি নিজেদের এলাকার বাইরে যাওয়ার আইনগত অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিলেন তারা। এক-দুই বছর নয়। যুগের পর যুগ এভাবেই রচিত হয়েছিল দীর্ঘ ৬৮ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস।

বিলুপ্ত বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির দাসিয়ারছড়া শাখার সভাপতি আলতাফ হোসেনের ভাষ্য, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শতভাগ বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সুবিধা, ২৭ কিলোমিটার পাকা সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট, মসজিদ, মন্দির এবং শ্মশান নির্মাণ করা হয়েছে। কমিউনিটি রিসোর্স সেন্টার, ডিজিটাল সার্ভিস এমপ্লয়মেন্ট ও ট্রেনিং সেন্টার এবং কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে।

দাসিয়ারছড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার মিনহাজুল ইসলাম জানালেন, এলাকাবাসীর দোরগাড়ায় চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিতে এখানে তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে দাসিয়ারছড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি নারীদের সন্তান প্রসব এবং প্রসূতি সেবার ব্যবস্থা রয়েছে।
দাসিয়ারছড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান খান জানালেন, বিনিময়ের আগে এই জনপদে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। এখন এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক পর্যায়ের চারটি এবং তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে।

দাসিয়ারছড়া ডিজিটাল সার্ভিস এমপ্লয়মেন্ট ও ট্রেনিং সেন্টারের প্রশিক্ষক আব্দুল হামিদ জানালেন, এই সেন্টারে চলতি বছরের মে মাস থেকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে।
ফুলবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দাসিয়ারছড়াকে বিভাজন করে ফুলবাড়ী সদর, কাশিপুর ও ভাঙামোড়- এই তিন ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত করে কৃষির উন্নয়নসহ সরকারের সামাজিক ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে শতভাগ মানুষকে। তিনি আরও জানান, সবচেয়ে দুরূহ কাজ ছিল ভূমি জরিপ ও রেকর্ড। তাও সম্পন্ন হয়েছে। আগের সংশ্নিষ্ট কাগজপত্র না থাকা সত্ত্বেও ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি- এই দেড় বছরে দাসিয়ারছড়ার ১ হাজার ৬৪৩ দশমিক ৪৪ একর জমি রেকর্ডভুক্ত করা হয়েছে। গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। ফলে খাজনা দেওয়াসহ রেজিস্ট্রি করে জমি কেনাবেচা করছেন অধিবাসীরা।

এ প্রসঙ্গে বিলুপ্ত বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি এবং এরই আলোকে হাসিনা-মনমোহন চুক্তির ফলে ছিটমহল বিনিময়ের মতো দুরূহ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। দ্রুততম সময়ে উন্নয়ন কাজ করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।

আরও পড়ুন

×