হোমল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স দখলের ছক!

সাহাদাত হোসেন পরশ
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২২ | ১৫:০১
বীমা প্রতিষ্ঠান হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সাত পরিচালক ও এক ভাইস চেয়ারম্যান হঠাৎ করেই মামলার জালে আটকা পড়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড সদস্য ১৪ জন। তাঁদের মধ্যে আটজন দীর্ঘ দিন ধরে বিদেশে বসবাস করছেন। কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) আগে মাগুরার একটি আদালতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আট ব্রিটিশ বীমা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এজিএম উপলক্ষে যুক্তরাজ্য থেকে সাতজন ঢাকায় ফিরলে গ্রেপ্তার হয়ে আট দিন কারাভোগও করেন। গত বৃহস্পতিবার তাঁরা জামিনে মুক্তি পান। এই বীমা পরিচালকদের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাঁদের আইনজীবীরা। তাঁরা বলছেন, কোম্পানি দখলে নিতে বোর্ড থেকে সরিয়ে দেওয়ার ছক এটি। মামলার অভিযোগ ও তথ্য-উপাত্ত হাস্যকর। মামলার পর হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স ঘিরে চলছে অস্থিরতা।
প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের আইনজীবী একেএম শফিকুজ্জামান বাচ্চু সমকালকে বলেন, চারজন বাদী সেজে একই অভিযোগে মাগুরার একই আদালতে মামলা করেন। যাদের সাক্ষী করা হয়েছে, তাদের নাম-ঠিকানাও নেই। এত দ্রুত মামলার সব কার্যক্রম চলেছে, যা রীতিমতো অস্বাভাবিক। আসামিরা কখনও মাগুরায় আসেননি। বাদীপক্ষ তাদের জীবনে দেখেনি। এই মামলায় কেন কোম্পানির মাগুরার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, বোর্ড চেয়ারম্যান বা সিইও আসামি হলেন না। বোর্ড মেম্বারদের মধ্যে যাঁরা বিদেশে থাকেন, তাঁদের শুধু আসামি করা হলো। আর এজিএমের দিন সভা চলাকালে পুলিশ তাঁদের ধরে নিল।
শফিকুজ্জামান আরও বলেন, এই মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন মাগুরার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুমনা পাল। আসামিদের গ্রেপ্তারের পর গত রোববার ওই আদালতে প্রথম শুনানি হয়। আদালত ওই দিন প্রডাকশন ওয়ারেন্ট জারি করেন। এর পর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আসামিদের দ্রুত মাগুরায় নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বৃহস্পতিবার তাঁরা জামিন পেয়েছেন। দেশে বিনিয়োগ করে প্রবাসীরা যদি এই ধরনের হয়রানি ও ষড়যন্ত্রের শিকার হন, তাহলে এটা তো দুঃখজনক। আর কোনো একটি বীমা কোম্পানির প্রত্যন্ত এলাকার কয়েকজন গ্রাহক কোম্পানির প্রবাসী পরিচালকদের সবার নাম জানবে- এটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
১৯৯৬ সালে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এর শাখা রয়েছে। কোম্পানির বোর্ড মেম্বার ১৪ জনের মধ্যে 'ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর' তিনজন। আর ১১ জন 'স্পন্সর ডিরেক্টর'। যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁরা সবাই দেশের বাইরে থাকেন।
কোম্পানির পরিচালক আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'আলামত দেখে মনে হচ্ছে, এর পেছনে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র আছে। কে কলকাঠি নাড়ছে- এটা প্রমাণ ছাড়া বলতে পারব না। তবে বোর্ড সদস্যদের মধ্যে যাঁদের বিরুদ্ধে এই ধরনের সাজানো মামলা হয়নি, তাঁদের মধ্য থেকে কেউ এর পেছনে থাকতে পারেন। তাঁরা কোম্পানির দখল নিতে চান।'
মামলার নথি থেকে জানা যায়, আদালতে দণ্ডবিধির ৪২০ ও ৪০৬ ধারায় যে চার মামলা করা হয়েছিল, তার একটির বাদী মাগুরার শিবরামপুরের সৈয়দ মোফাক্কার আলী। আসামিরা হলেন- হোমল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান জামাল মিয়া, পরিচালক আব্দুর রব, কামাল মিয়া, আব্দুর রাজ্জাক, জামাল উদ্দিন, আব্দুল আহাদ ও আব্দুল হাই। মামলায় অভিযোগ করা হয়, পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মাগুরার আঞ্চলিক অফিসে গেলে ওই অফিসের কর্মকর্তারা টাকা পরিশোধ না করে টালবাহানা করতে থাকেন। টাকা না দিয়ে অফিস থেকে তাড়িয়ে দেন। পারলে মামলা করে টাকা আদায় করতে বলেন। মামলায় আঞ্চলিক অফিসের কর্মকর্তাদের টালবাহানার অভিযোগ করা হলেও কেন সাত প্রবাসী পরিচালককে আসামি করা হলো- এমন প্রশ্নে বাদী মোফাক্কার আলী বলেন, 'একটি ডায়েরি পেয়েছিলাম। সেখানে পরিচালক হিসেবে তাঁদের নাম ছিল। অন্যদের চিনি না। আর স্থানীয় কারও নামও জানা নেই।' কোম্পানির অন্য পরিচালকদের আসামি না করে বিদেশে অবস্থান করা সাতজনকে আসামি করলেন কেন- এ প্রশ্নে বাদী আগের কথা বদলে ফেলেন। তাঁর ভাষ্য- হাবিবুর নামে আরেকজন গ্রাহক আসামি হিসেবে ওই নামগুলো তাঁর কাছে দেন। পলিসির ৩০ হাজার টাকা তাঁর পাওনা আছে। ২০৬ টাকা করে মাসে কিস্তি দিতেন তিনি। তাঁর মামলায় ৩৯ জন সাক্ষীর মোট পাওনা সাড়ে ৪ লাখ টাকা। আরেকটি মামলায় আরেক প্রবাসী ব্যবসায়ী ফয়জুল হককে আসামি করা হয়। তিনিও কোম্পানির পরিচালক। অসুস্থ থাকার কারণে ফয়জুল দেশে আসতে পারেননি।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত মে মাসে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম তালুকদারের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। পরে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন বি কে মণ্ডল। ছয় দফা কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মো. জুলহাস। আজিজুলের চুক্তি শেষ হওয়ার পর তাঁর কিছু দুর্নীতির তথ্য সামনে আসতে থাকে। মূল্য কম দেখিয়ে জায়গা বিক্রি করে দেন তিনি। এবারের বোর্ড সভায় চেয়ারম্যানকে বদলের চিন্তাভাবনা ছিল। যাতে নতুন চেয়ারম্যান এসে আজিজুলের দুর্নীতির তদন্ত সঠিকভাবে বের করে আনতে পারেন।
কোম্পানির পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ২১ সেপ্টেম্বর এজিএম চলাকালে হঠাৎ মতিঝিল থানার এসআই শফিক কোম্পানির মতিঝিলের কার্যালয়ে হাজির হন। এর পর বিদেশ থেকে আসা সাত পরিচালককে আলাদা করা হয়। তাঁদের গ্রেপ্তার করে মতিঝিল থানায় নেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় সেখানে বসিয়ে রাখার পর আদালতে নেওয়া হয়। আদালত এলাকায় নিয়েও অনেক সময় ধরে গাড়ির ভেতরেই তাঁদের রাখা হয়। কৌশল করেই বিলম্বে হাজির করার কারণে প্রথম দিন জামিন শুনানি হয়নি। পরদিন মামলার খণ্ড নথি ঢাকার আদালতে হাজির না করে মাগুরায় পাঠিয়ে দেয় পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগ। নথি না পাওয়ার কারণে আদালত কোনো আদেশ দিতে পারেননি। রাজ্জাক বলেন, সরকারের কাছে ন্যায়বিচার চাই। এভাবে নাজেহাল হলে কেউ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবেন না। আমাদের সন্তানরাও দেশে আসতে দেবে না।
কোম্পানির আরেক পরিচালক কামাল মিয়া বলেন, আটজন পরিচালক প্রবাসী। কারও কারও ধারণা, ভয় দেখালে প্রবাসীরা আর দেশে আসবেন না। এর পর তাঁরা কোম্পানি ঘিরে যা খুশি তা করতে পারবেন। এ ছাড়া কয়েক মাস থেকে কোম্পানির পুরোনো কর্মীদের ছাঁটাই চলছে।
আরেক পরিচালক আক্ষেপ করে বললেন, শেষ বয়সে এসে এই প্রথম কারাগারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হলো। লন্ডন থেকে আসার আগে আশঙ্কা ছিল, ঢাকায় কোনো বিপদে পড়তে পারি। ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছিলাম। সন্তানকে বলেও এসেছি, খোঁজখবর না পেলে কারাগারে অথবা হাসপাতালে খোঁজ নিতে। সেটাই সত্যি হলো।