ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

সাক্ষাৎকার: আলী ইমাম মজুমদার

চাকরিচ্যুতির বিধান বাতিলের আদেশ আসেনি আদালত থেকে

চাকরিচ্যুতির বিধান বাতিলের আদেশ আসেনি আদালত থেকে

--

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০

আলী ইমাম মজুমদার। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব। মাঠ প্রশাসনের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করে অলংকৃত করেছেন প্রশাসনের শীর্ষতম পদ। সরকারি চাকরি শেষে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

সমকাল: এক সচিব, তিন পুলিশ সুপারকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ায় প্রশাসনে একধরনের চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে।

আলী ইমাম মজুমদার: এটা ঠিক সচিব ও পুলিশ কর্মকর্তাদের আকস্মিক অবসরে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এটি তো নতুন কোনো বিষয় না। চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই এক দিনে এর চেয়েও বেশিসংখ্যক কর্মকর্তাকে এভাবে অবসরে দিয়েছিল। তাঁদের বেশিরভাগই মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে আমাদের সহকর্মীদের মধ্যেও কেউ কেউ এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন। এই নিয়মটি ১৯৭৪ সাল থেকেই আছে। সেটিই ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনে নতুন করে নেওয়া হয়েছে।

সমকাল: বাধ্যতামূলক অবসরে দেওয়াকে কেউ কেউ কালাকানুন বলে অবহিত করছেন।

আলী ইমাম মজুমদার: এমন অভিমতের সঙ্গে আমি দ্বিমত করব না। কিন্তু যাঁরা এভাবে চাকরি হারিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে গিয়েছেন তাঁদের সবাই চাকরি ফিরে পেয়েছেন। এই ক্ষেত্রে আদালত যাঁরা প্রতিকার চেয়েছেন শুধু তাঁদের ক্ষেত্রে অর্থাৎ আবেদনকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতিকার দিয়েছেন। অনেক আইনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো একটি বিষয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা হলে, সংশ্নিষ্ট বিষয়টি যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে সেটি (আইনের ধারা) বাতিল করে রায় দেওয়ার নজির আছে। কিন্তু বাধ্যতামূলক চাকরিচ্যুতির বিধান বাতিলের আদেশ আদালত থেকে আসেনি।

সমকাল: চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই এমন পদক্ষেপ নিয়েছিল। বর্তমান সরকার টানা ক্ষমতায় থাকার দীর্ঘদিন পর এ আইন ব্যবহার করল। এতে বিশেষ কোনো বার্তা বহন করে কিনা?

আলী ইমাম মজুমদার: এটি বিশেষ কোনো বার্তা বহন করে কিনা আমার জানা নেই। আমার চাকরি শেষ হয়েছে অনেক বছর। কোনো মন্ত্রণালয়েই আমার যোগাযোগ নেই। যে সচিবকে অবসরে দেওয়া হয়েছে তাঁর বিষয়ে আমার জানাশোনাও নেই।

সমকাল: দীর্ঘদিন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেছেন। প্রশাসন মান আগের চেয়ে ভালো নাকি খারাপ হয়েছে?

আলী ইমাম মজুমদার: এটা দুই দিক থেকে দেখতে হবে। বর্তমানে প্রশাসনের অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে, যতটা আমাদের সময় ছিল না। মানের দিকটা একেকজন একেকভাবে দেখবেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার মনে হয় প্রশাসন আগের মান বজায় রাখতে পারছে না।

সমকাল: কোন ক্ষেত্রে বেশি চ্যালেঞ্জ দেখছেন আপনি?

আলী ইমাম মজুমদার: করোনাভাইরাসের মতো বড় একটি সংকট অনেকটা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পেরেছে প্রশাসন।

সমকাল: এটি তো বৈশ্বিক সংকট। স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতির বিষয়ে প্রশাসন কতটা ভালো করতে পারছে?

আলী ইমাম মজুমদার: করোনা বৈশ্বিক সংকট হলেও প্রশাসনকে এটি মোকাবিলা করতে হয়েছে। ২০০৮ সালের পর থেকে দেশে কোনো গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। আমরা যখন ডিসি ছিলাম তখন সাফল্যের সঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছি। ওই সময়ের কাজ নিয়ে আমরা গৌরব করি। এই গৌরববোধের মধ্যে বর্তমান প্রশাসন নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর থেকে আমাদের দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে চ্যালেঞ্জ সে অর্থে তারা মোকাবিলা করেনি। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে হবে জানি না।

সমকাল: নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রশাসন প্রত্যাশিত মান ধরে রাখতে পারছে না, এর কারণ কী?

আলী ইমাম মজুমদার: যেখানে নির্বাচনী ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে, একটি দলই ক্ষমতায় আছে, তারাই থাকবে। সুতরাং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে কর্মকর্তারাও উদগ্রীব, তেমনি যে দল ক্ষমতায় আছে তাদের (প্রশাসন) নিয়েই চলতে হবে, তাই (সরকারি চাকুরেদের) সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিয়ে সঙ্গে রাখার চেষ্টা করে। এভাবে দলীয়করণের প্রভাবটা বাড়ছে।

সমকাল: রাজনৈতিক দলগুলো তো নিজেদের মতো করে কাছে টানতে চাইতেই পারে। সেখানে প্রশাসন গা ভাসিয়ে দেবে কেন?

আলী ইমাম মজুমদার: এটি ভুল ধারণা। প্রকৃত রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেটি চাইবেন না। তাঁরা চাইবেন তাঁদের রাজনীতি তাঁরা করবেন। রাজনীতিকরা মনে করবেন, আমরা আজকে আছি, কাল থাকব না। কিন্তু প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে এসেছেন। তাঁরা কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন, নানান প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, যে কোনো চ্যালেঞ্জ আসুক, সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যাতে সরকারি চাকুরেরা দক্ষতা অর্জন করতে পারেন, রাজনীতিকরা তাই চাইবেন। তাই প্রশাসন যাতে কোনো দলের হিসেবে পরিচিত না হয়, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বের। রাজনৈতিক নেতৃত্বের এমন কমিটমেন্ট থাকলে কর্মকর্তারা দলীকরণের দিকে ঝুঁকতে পারবেন না।

সমকাল: মানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঠিক না হলে প্রশাসন ঠিক হওয়া সম্ভব না?

আলী ইমাম মজুমদার: আমরা কেউ বিচ্ছিন্ন বদ্বীপে বসবাস করি না। এই দেশ স্বাধীন হয়েছে আমাদের রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে। ওই সময় রাজনীতিকদের চেয়ে অনেক লেখাপড়া জানা লোকজন সিভিল সার্ভিসে ছিল। তারা দেশ স্বাধীনে নেতৃত্ব দেয়নি। তাই এ ক্ষেত্রেও রাজনীতিকদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, কার্যকর নির্বাচন ব্যবস্থা যদি ফিরে আসে, এতে যে কোনো দল ক্ষমতায় আসার প্রতিযোগিতা থাকে তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দলীয়করণ কমে যাবে।

সমকাল: ব্রিটিশ আমলের জেলা প্রশাসন শত শত বছর পার করছে। কালেক্টরেট দিয়ে শুরু, এরপর জেলা ম্যাজিস্ট্রেসি, ডেপুটি কমিশনারের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। মাঠ প্রশাসনের সংস্কার করা প্রয়োজন কিনা?

আলী ইমাম মজুমদার: জেলা প্রশাসন খুব পরীক্ষিত একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে নতুন করে রিভিউ করার দরকার আছে বলে মনে হয়। বিভিন্ন আইনে মোবাইল কোর্ট যুক্ত করে জেলা প্রশাসনকে তা বাস্তবায়নে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর বাইরে ভিজিএফ, টিসিবি, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ সমসাময়িক প্রায় সবক্ষেত্রেই জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব অনেক বেড়েছে। অনেক দক্ষতার সঙ্গে তারা কাজও করছে।

সমকাল: নির্বাচনকেন্দ্রিক কার্যক্রমে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে জেলা প্রশাসনের ভালো কাজগুলো কী আড়াল হয়ে যাচ্ছে?

আলী ইমাম মজুমদার: দেখেন ভারতের নির্বাচন কমিশন মাত্র তিনশ কর্মর্কতা দিয়ে নির্বাচনী কাজ পরিচালনা করে। প্রায় সব কাজ উঠিয়ে দেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সেখানকার নির্বাচন নিয়ে তো প্রশ্ন উঠে না। এখানে প্রশাসনের ভূমিকার চেয়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ।

সমকাল: যুক্তরাষ্ট্রের 'স্পয়েল' সিস্টেম আমলাতন্ত্র অর্থাৎ যে দল ক্ষমতায় আসবে তাদের লোকজন দিয়েই প্রশাসন সাজানো। এই বিষয়টি কী বাংলাদেশে চিন্তা করা যায়?

আলী ইমাম মজুমদার: যুক্তরাষ্ট্রের এই পদ্ধতি সম্পর্কে অনেকেরই ভুল ধারণা আছে। সে দেশের আমলাতন্ত্রের খুব ছোট একটি অংশ দল পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তন হয়। আবার এটি নিয়েও বিতর্ক আছে। কেউ কেউ চাচ্ছে দলীয় সিস্টেমের আমলাতন্ত্র কমাতে। আবার কেউ কেউ বাড়ানোর পক্ষে।

ভারত আমাদের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর গণতন্ত্র চর্চা করছে। তারাই এ বিষয়টি চিন্তা করতে পারছে না। বাংলাদেশে এ ব্যবস্থা চিন্তায় যাওয়া ঠিক হবে না।

সমকাল: দুই দশক আগে সর্বশেষ প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন হয়েছিল। নতুন সংস্কার কমিশন গঠন হওয়ার সময়ে এসেছে কিনা?

আলী ইমাম মজুমদার: আগের সংস্কার কমিশনের রিপোর্টকে সামনে রেখেই নতুন করে প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন হওয়া দরকার। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার একটি কমিশন করেছিল। কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলো সেই কমিশনের সুপারিশ সামান্য কিছু আমলে নিলেও বড় আকারে বাস্তবায়ন করেনি। ওই কমিশনের সুপারিশে কোটা সংস্কার করতে পরামর্শ ছিল। কিন্তু সরকার কোটা সংস্কার করল ছাত্রদের আন্দোলন করার পর। শুধু সরকারি চাকরিই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষকরা পর্যন্ত তাদের পোষ্য কোটায় ছাত্র ভর্তি করিয়ে মেধাবীদের বঞ্চিত করেন। এগুলো বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।

সমকাল: প্রশাসনিক সংস্কারসংক্রান্ত স্থায়ী কমিশন কী থাকতে পারে?

আলী ইমাম মজুমদার: সরকার এভাবে চিন্তা করবে কিনা জানি না। কমিশন ছাড়াও সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। যেমন কোটা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যে পরিবর্তন আনা হলো সেটিও তো বড় একটি সংস্কার।

সমকাল: তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ ক্ষেত্রে পিএসসির আদলে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগ হলে দুর্নীতি কমতে পারে কি?

আলী ইমাম মজুমদার: বর্তমান পিএসসির ওপর আর কোনো দায়িত্ব চাপানো ঠিক হবে না।

সমকাল: নতুন কমিশন হতে পারে কি?

আলী ইমাম মজুমদার: তা হতে পারে। একইসঙ্গে সাধারণ ও বিশেষ ক্ষেত্রের নিয়োগ পৃথকভাবে চিন্তা করা যেতে পারে। যেমন শিক্ষা ক্যাডারকে একটি ক্যাডার হিসেবে অভিহিত করলেও এর মধ্যে অনেক ভাগ। প্রতিটি বিষয়ের জন্য পৃথক প্রার্থীদের বাছাই করতে হয়। যেমন- করোনার সময় বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে কয়েক হাজার ডাক্তার দ্রুত নিয়োগ দেওয়া হলো। এভাবে বিশেষ ক্ষেত্রের প্রার্থীদের দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায় না ফেলে বাছাই পরীক্ষার পর সরাসরি ভাইভার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

সমকাল: প্রশাসন নিয়ে গণমাধ্যম যে কাজ করে সে সম্পর্কে আপনার কোনো মূল্যায়ন।

আলী ইমাম মজুমদার: মানুষের জানার অধিকার পূরণ করার দায়িত্ব পালন করেন সাংবাদিকরা। তাই সংবাদকর্মী হিসেবে সঠিক তথ্য পরিবেশন করাই গণমাধ্যমের দায়িত্ব। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জানাশোনা ছাড়াই অনেকে রিপোর্ট করে দেন। এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।

আরও পড়ুন

×