শহীদ পরিবারের জীবনযুদ্ধ
বাবার কবর সংরক্ষণে এসে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন প্রবাসী পুত্র

আবু সালেহ রনি
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৫:১৭
রেডিও পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ বেতার) অনুষ্ঠান সংগঠক ছিলেন মহিউদ্দিন হায়দার। ১৯৭১ সালে রংপুর কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন তিনি। প্রাণচঞ্চল ও শিল্পীমনা মানুষটি গল্প, কবিতা ও গান লিখতেন। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট রংপুর বেতারকেন্দ্র থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তান বাহিনী। তার পর অনেক খুঁজেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
স্বাধীনতার পর তাঁর বড় ভাই জিয়াউদ্দিন হায়দার অনেক খোঁজ-খবর করে জানতে পারেন, পাকিস্তানি সেনারা মহিউদ্দিনকে হত্যার পর শ্যামপুর মিলের কাছে আখক্ষেতে ফেলে রেখে যায়। পরে মিলের কর্মী ও গ্রামবাসী বর্তমান শ্যামপুর ডিগ্রি কলেজের উত্তর পাশে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তার ধারে তাঁকে সমাহিত করেন। স্বাধীনতার ৫১ বছরেও মহিউদ্দিন হায়দারের কবর সংরক্ষণ করা হয়নি। তাঁর বড় ছেলে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী শাহেদ সদরুদ্দিন দেশে এসে গত ৪ আগস্ট থেকে বাবার কবরের জমি কেনার চেষ্টা চালিয়ে এখনও সফল হননি। প্রশাসন ও জমির মালিকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি।
শাহেদ সদরুদ্দিন সমকালকে বলেন, 'বাবার কবর চিহ্ন দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়নি। কবর দেওয়ার স্থানটি স্থানীয় গ্রামবাসীর মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়েছে। যাঁরা মরদেহ কবরস্থ করেছিলেন তাঁদের অনেকে এখনও জীবিত। আমরা দুই ভাই চাইছি আমাদের শহীদ বাবার কবর সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা হোক। সেজন্য কবরের নির্ধারিত জমি কেনা প্রয়োজন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেই চেষ্টাও চালিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত জমির মালিক তাতে সাড়া দেননি। স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার, ইউএনওসহ সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তাঁদের পরামর্শে গত ৮ নভেম্বর এ বিষয়ে সহযোগিতা চেয়ে রংপুর জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছি।'
জমির মালিক মো. রাসেল মিয়ার নজরে নেওয়া হলে তিনি বলেন, 'যে জায়গার কথা বলা হচ্ছে তার পাশে স্বাধীনের পর আমার বাবাকে কবর দেওয়া হয়েছে। জমি বিক্রি করা সম্ভব নয়।'
বিষয়টি অবহিত করে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, 'জমি বিক্রি করতে না চাওয়ার অধিকার মালিকের রয়েছে। তবে সরকার যদি মনে করে তাহলে অধিগ্রহণ করতে পারে। শহীদ পরিবার সুনির্দিষ্টভাবে লিখিত আবেদন করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেটা আপসে বা অধিগ্রহণ যেটাই হোক, হতে পারে।'
শহীদ মহিউদ্দীন হায়দার ১৯৩৫ সালের ৫ জুলাই পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শিক্ষাবিদ সদরুদ্দীন আহমেদ। মা নেগজান নেছা। এক বোন ও ছয় ভাইয়ের মধ্যে মহিউদ্দীন ছিলেন সবার ছোট। তাঁর বড় ভাই জিয়াউদ্দীন হায়দার একজন কবি। সেজো ভাই ডা. সাঈদ হায়দার ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এবং মেডিকেলের ছাত্র হিসেবে প্রথম স্মৃতিস্তম্ভের নকশা করেছিলেন তিনিই, যে স্থাপনাটি পরের দিনই পুলিশ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।
মহিউদ্দীন হায়দার ১৯৬৭ সালে যোগ দিয়েছিলেন রেডিও পাকিস্তানের রাজশাহী কেন্দ্রে। তাঁর দুই ছেলে শাহেদ সদরুদ্দিন ও ইমতিয়াজ মহিউদ্দীন জয়। স্ত্রী খুরশিদা হায়দার।
১৯৭১ সালে মহিউদ্দীন হায়দার প্রোগ্রাম অর্গানাইজার হিসেবে রংপুর বেতার কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। ২৫ মার্চের আগে তিনি সপরিবারে দিনাজপুরে তাঁর মেজো ভাই শামসুদ্দীন হায়দারের বাসায় যান। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তখন তাঁরা উদ্বিগ্ন ছিলেন। মেজো ভাই সপরিবারে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। মহিউদ্দীনের স্ত্রী ছিলেন দ্বিতীয়বারের মতো সন্তানসম্ভবা। এ জন্য সার্বিক পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে মহিউদ্দীন স্ত্রীকে দিনাজপুর মিশন হাসপাতালে ভর্তি রেখে কারফিউ পাস নিয়ে রংপুরে ফিরে আসেন। মায়ের সঙ্গে ১৪ মাসের বড় ছেলেকেও তিনি রেখে যান। কয়েক দিন পর ওই হাসপাতালে তাঁর ছোট ছেলের জন্ম হয়। এর কিছুদিন পর এক উর্দুভাষী আইনজীবীর সহায়তায় স্ত্রী-সন্তানদের রংপুরে নিয়ে আসেন। বাংলার একদিন জয় হবে, এই বিশ্বাস থেকে মহিউদ্দীন তাঁর ছোট ছেলের নাম রাখেন জয়। তখন বাসা থেকেই নিয়মিত অফিস করতেন তিনি।
ঘটনার দিন অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট রোববার ছুটির দিন হলেও তিনি জরুরি কাজের জন্য সকালে অফিসে রওনা হন। গাড়িতে তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন সহকর্মী ছিলেন। কিন্তু বেতার কেন্দ্রের গেটে গাড়ি পৌঁছানোর পরপরই তল্লাশি চালায় প্রহরারত পাকিস্তানি সেনারা। গাড়িতে বোমা পাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে তখন কয়েকজন সহযাত্রীসহ তাঁকে আটক করে রংপুর সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর অন্যদের ছেড়ে দেওয়া হলেও মহিউদ্দীন ও তাঁর গাড়িচালকের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
স্বাধীনতার পর খুঁজতে খুঁজতে মহিউদ্দীনের বড় ভাই জিয়াউদ্দীন হায়দার শ্যামপুর সুগার মিলের ম্যানেজার মোসলেহ উদ্দীনের কাছ থেকে জানতে পারেন, মহিউদ্দীনকে হত্যা করা হয়েছে। মিলের কর্মীরা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তার ধারে স্যুট-টাই পরা অবস্থায়ই মরদেহের গোসল ছাড়া জানাজা পড়ে সমাহিত করেছিল। পকেটে মহিউদ্দীনের অফিসিয়াল পরিচয়পত্র পাওয়া যায়। ওই সূত্রে শ্যামপুর চিনিকলের আবাসিক চিকিৎসকের কাছ থেকে তাঁর মৃত্যুসনদ নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে ওই মৃত্যুসনদ মহিউদ্দীনের পরিবারের কাছে রয়েছে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু মহিউদ্দীনের স্ত্রী খুরশীদা হায়দারকে বেতারে চাকরি দেন এবং রাজধানীর আজিমপুরে থাকার জন্য বাড়ি বরাদ্দ দেন। ২০০৭ সালে ওই বাড়ির বরাদ্দ বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পরে হাইকোর্ট ওই আদেশ স্থগিত করলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেখা দেয়। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় তাঁদের আজিমপুরে নতুন ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে শহীদ মহিউদ্দীন হায়দারের স্মরণে ডাকবিভাগ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো প্রণীত শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ওই তালিকায় মহিউদ্দীনের নাম গেজেটে ১০৭ নম্বরে রয়েছে।