ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

ময়দান যার নামে সেই সংগঠকেরও স্বীকৃতি মেলেনি

ময়দান যার নামে সেই সংগঠকেরও স্বীকৃতি মেলেনি

আবু সালেহ রনি

প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৬:০৪

শহীদ ডা. কাজী আবুল কাশেম বাস করতেন জয়পুরহাট শহরের দেবীপুর এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করায় তাঁকে ধরে নিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে তুলে দেয় রাজাকাররা। পাকিস্তান বাহিনী তাঁকে জিপের পেছনে রশি দিয়ে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে বহু পথ নিয়ে শেষে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

স্বাধীনতার পর জয়পুরহাট শহরে যে ময়দানে ভাষা আন্দোলনের স্মারক শহীদ মিনার রয়েছে, সেটিকে শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দান বলে নামকরণ করে জেলা প্রশাসন। পাচুর মোড়ে দক্ষিণ দিকের এই ময়দান স্থানীয়ভাবে জনসাধারণের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের একটি কেন্দ্রীয় স্থান। শহীদ মিনারের কাছেই স্বাধীনতার প্রতীক ৭১ ফুট উঁচু স্মৃতিস্তম্ভ। শহীদ দিবসের প্রভাতফেরি শেষে ফুল দিয়ে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিতর্পণ, আলোচনা সভা এবং মুক্তিযুদ্ধ-সংশ্নিষ্ট স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের কর্মসূচি এ ময়দানেই পালিত হয়। ময়দানের নামকরণ হলেও, বিস্ময়করভাবে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ তালিকায় স্বাধীনতার ৫১ বছরেও স্বীকৃতি মেলেনি ডা. আবুল কাশেমের। জেলা প্রশাসনের কাছে বিভিন্ন সময় শহীদের মেয়ে লাইলী বেগম স্বীকৃতির দাবি জানালেও তা হয়নি। মেয়ের আর্তি- কবে মিলবে বাবার শহীদ স্বীকৃতি?

লাইলী বেগম কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া আলীমের মৃত্যু হয় কারাগারে।

লাইলী বেগম সমকালকে বলেন, 'শহীদ তালিকায় আমার বাবার নামই নেই! আমার স্বামী মারা গেছেন ১৯৮৬ সালে। সেই থেকে ৬ ছেলেমেয়ে নিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছি। সন্তানদের কেউ সরকারি চাকরি-বাকরি পায়নি।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা দুই ভাই, দুই বোন ছিলাম। মা ও দুই ভাই মারা গেছেন। আমাদের এখন দেখার কেউ নেই।'

ডা. আবুল কাশেমের জন্ম ১৯২৩ সালে। বাবা কাজী মানিক উদ্দিন, মা বিবিজন বেওয়া। তিনি তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে চতুর্থ। আবুল কাশেম কুড়িগ্রাম থেকে হোমিওপ্যাথি ডিগ্রি লাভ করে জয়পুরহাটে চিকিৎসকের কর্মজীবন শুরু করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম সখিনা বিবি।

আবুল কাশেম মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। হোমিও চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি ইউনিয়ন পরিষদে পাঁচবারের নির্বাচিত মেম্বার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতেই তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে থাকেন। তা জেনে যায় পাকিস্তানিদের দোসর রাজাকার বাহিনী। ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই ভোরে আবুল কাশেমের বাড়ি তারা ঘেরাও করে। প্রথমে বড় ছেলেকে ধরে নেয়। পরে তাঁকে দিয়ে ডাকিয়ে আবুল কাশেমকে ঘুম থেকে তোলা হয়। এর পর ছেলেকে রেখে আবুল কাশেমকে ধরে মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল আলীমের গদিঘরে নেয় রাজাকাররা। স্থানীয় শওনলাল বাজলার গদিঘরটি আব্দুল আলীম ও তার সহযোগীরা দখল করে শান্তি কমিটির অফিস বানিয়েছিল। গদিঘরে গিয়ে আবুল কাশেমকে ছাড়িয়ে আনতে তাঁর পরিবারের লোকেরা টাকা, সোনা-গয়না দিয়েছিলেন; কিন্তু ছাড়াতে পারেননি। গদিঘর থেকে রাজাকাররা পরে আবুল কাশেমকে কুঠিবাড়ী রেজিস্ট্রি অফিসে স্থাপিত পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁকে হাত-পা বেঁধে, গাছে টাঙিয়ে নির্যাতন করা হয়। এর পর ২৬ জুলাই পাকিস্তানি বাহিনী তাদের জিপের পেছনে রশি দিয়ে তাঁকে বেঁধে টেনে প্রায় ১৭ কিলোমিটার পথ ঘুরে চকবরকত পাগলা দেওয়ান এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁকে হত্যার পর সদরের কুঠিবাড়ী ব্রিজের পাশে নদীর চরে ফেলে দেয়।

১৯৭২ সালের নভেম্বরে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে আবুল কাশেমের মরদেহ শনাক্ত করে দেবীপুরে এনে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। জয়পুরহাটে পাকিস্তান বাহিনীর এদেশীয় অন্যতম দোসর ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল আলীম। তাঁর নির্দেশেই জয়পুরহাটে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণসহ নানা অপরাধের দোসর হয়ে রাজাকাররা কাজ করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন। পরে কারাগারে থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

জয়পুরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আমজাদ হোসেন সমকালকে বলেন, 'শহীদ আবুল কাশেমের নামে জয়পুরহাটে ময়দান আছে ঠিকই; কিন্তু তাঁর নাম শহীদ তালিকায় নেই। পরিবারের কেউ ভাতা বা অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা পাননি কখনও। শহীদ ইয়াকুব আলী মণ্ডলসহ এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন; মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে স্থানীয়ভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁদের স্বীকৃতি দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য। তরুণ প্রজন্মের কাছে স্থানীয়ভাবে যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের তুলে ধরা দরকার। নয়তো এ জাতি অদূর ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে পারে।'

জানতে চাইলে জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক মো. শরিফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, 'শহীদ আবুল কাশেম স্মরণে জেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও ময়দানের নামকরণ করা হয়েছে বহু আগেই। কিন্তু জেলার নথিপত্রে এই শহীদের নাম নেই। পরিবারটি তাঁর শহীদ স্বীকৃতির জন্য আমাদের কাছে আবেদন করেছে। ডা. আবুল কাশেমের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'

জয়পুরহাট জেলা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীমুক্ত হয়। স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত তিনটি বধ্যভূমি অর্থাৎ জেলা সদরের পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমি, কড়ই কাদিপুর বধ্যভূমি ও আক্কেলপুরের আমুট্ট বধ্যভূমি সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আক্কেলপুরে ১৯৭১ সালে ২২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তান বাহিনী হত্যা করে। পশ্চিম আমুট্ট মৌজায় দুটি গণকবর রয়েছে। এখানে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। জয়পুরহাট জেলা শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে পাগলা দেওয়ান গ্রামে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ১২২ জন গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এখানেও স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। জনশ্রুতি আছে, ১৯৭১ সালের ১৮ জুন প্রায় ১০ হাজার নিরীহ বাঙালিকে এখানে নির্মমভাবে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কড়ই কাদিপুরে পাকিস্তান বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল ৩৭১ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মৃৎশিল্পের কারিগরকে সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এসব শহীদ স্মরণে এখানে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ্ভ। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এখন পর্যন্ত ৫৬টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে গত দুই বছরে। তবে এগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি।

জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক বলেন, 'চিহ্নিত হওয়া সব বধ্যভূমি সংরক্ষণে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে দুটি বধ্যভূমি সংরক্ষণে কাজ শুরু হবে। অন্যান্য বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিষয় রয়েছে। সেই প্রক্রিয়াও শুরু হবে।'

আরও পড়ুন

×