শিক্ষাঙ্গনে টর্চার সেল -৩
মতের অমিল হলেই 'মাইর' চলে চবিতে

সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০১৯ | ১৩:১৮
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আতঙ্কের নাম 'বড় ভাই'।
ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকা এ বড় ভাইরা মতের অমিল হলেই শুরু করেন মারধর।
আগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হলে এনে এভাবে শায়েস্তা করত ছাত্রশিবির। তখন
চবির সবকটি হলের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের কাছে। এখন এ ভূমিকায় আছে ছাত্রলীগ।
পুরো ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণও এখন তাদের কাছে। শুধু সাধারণ শিক্ষার্থী নয়,
নিজ দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও প্রতিনিয়ত মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছেন তারা।
ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের কোনো অস্তিত্ব না থাকায় চবিতে ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ
এখন ছাত্রলীগই।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে টর্চার থাকলেও হলকেন্দ্রিক 'টর্চার সেল' নেই। তবে এখানে
সাধারণ শিক্ষার্থীদের কষ্টের আরেক কারণ হচ্ছে শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক
গ্রুপ। নিষিদ্ধ থাকার পরও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে
শাটল ট্রেনে দখল করে রাখে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সিট। এটি নিয়েও অনেকবার
মারামারির ঘটনা ঘটেছে চবিতে। এ ছাড়া চবিতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের
বিরুদ্ধে চুরি-ছিনতাই, নিজ দলের কর্মী হত্যা, দলীয় নেতার হাত-পায়ের রগ
কর্তন, সাংবাদিক নির্যাতন, প্রহরীকে মারধর, প্রশাসনিক ভবনে তালা দেওয়া, হলে
অস্ত্র মজুদ ও দফায় দফায় নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়ানোর ঘটনা ঘটছে নিয়মিত।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় একাধিকবার স্থগিত করা হয়েছিল চবি
ছাত্রলীগের কার্যক্রম। সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে নতুন কমিটিও। সামান্য ঘটনা
নিয়ে নতুন কমিটির নেতাকর্মীরাও এরই মধ্যে নিজেদের মধ্যে লিপ্ত হয়েছেন
সংঘর্ষে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড.
শিরীণ আখতার বলেন, 'অতীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হয়েছে সেটি নিয়ে আমি
কিছু বলতে চাই না। তবে এখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ মাস্তানি করতে পারবে না।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে হলে যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে,
সেজন্য সতর্ক আছি আমরা। এরই মধ্যে সবকয়টি হল পরিদর্শন করেছি আমি। আবাসিক
শিক্ষকরা যাতে হলে অবস্থান করেন, সে ব্যাপারেও কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে।
চবিতে কোনো টর্চার সেল নেই। এটি নতুন করে তৈরি করারও সুযোগ যাতে কেউ না
পায়, সেজন্য সতর্ক আছে প্রশাসন।' ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে
চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মারামারির অভিযোগ থাকা প্রসঙ্গে চবি ছাত্রলীগের
নতুন কমিটির সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেন, 'চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে
হলকেন্দ্রিক শিক্ষার্থী নির্যাতন করত ছাত্রশিবির। আমরা সেটি বন্ধ করেছি।
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অন্যান্য যেসব অভিযোগ আছে, সেগুলোও এখন নেই। নতুন
কমিটি চেষ্টা করছে ছাত্রলীগের হারানো ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে।
ছাত্রলীগের আমলে কোনো টর্চার সেল গড়ে না ওঠাও এই চেষ্টার অংশ।'
মতের অমিল হলেই মারামারি শুরু হয় চবিতে :চবিতে মতের অমিল হলেই শুরু হয়
মারধর। সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে নিজ দলের নেতাকর্মীরাও বাদ যান না
মাইর থেকে। চবিতে এ সংস্কৃতি গড়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের
গ্রুপিং। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পৃথক দুটি গ্রুপ
থেকে মনোনীত করত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতিতে প্রয়াত
সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের
পৃথক দুটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এটির প্রভাব প্রবলভাবে আছে এখানকার সব ছাত্র
সংগঠনে। কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও তাই ভারসাম্য রক্ষা করতে হয় কেন্দ্রকে। দুই
গ্রুপ থেকে শীর্ষ দুই নেতা মনোনীত করতে গিয়েই বপন করা হয় অশান্তির বীজ।
চবিতে এটির নেতিবাচক প্রভাব বিরাজ করছে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। মাস তিনেক
আগে চবিতে ছাত্রলীগের যে নতুন কমিটি হয়েছে, সেখানেও দুই গ্রুপ থেকে দু'জনকে
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সভাপতি রেজাউল করিম রুবেল
হচ্ছেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর গ্রুপের অনুসারী। আর সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন
টিপু হচ্ছেন আ জ ম নাছির উদ্দীন গ্রুপের অনুসারী। এর আগে ২০১৫ সালের ২০
জুলাই আলমগীর টিপুকে সভাপতি ও ফজলে রাব্বী সুজনকে সাধারণ সম্পাদক করে চবি
ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী সুজন নগর
আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী। আর সভাপতি
আলমগীর টিপু ছিলেন চসিক মেয়র আ জ ম নাছিরের অনুসারী। শীর্ষ দুই নেতা দুই
গ্রুপের অনুসারী হওয়ায় আলাদাভাবে ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার করতে চান তাদের
নেতাকর্মীরা। এ জন্য নিজেদের মধ্যে মারামারিতে লিপ্ত হন তারা। তাদের
নির্যাতনের শিকার হয় সাধারণ শিক্ষার্থীরাও।
মারামারির নেপথ্যে আধিপত্য বিস্তার : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন
ধরে ছাত্রলীগে অস্থিরতার নেপথ্যে রয়েছে আধিপত্য বিস্তার। টেন্ডারের
নিয়ন্ত্রণ ও হলে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেই বারবার সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা। শতকোটি টাকার টেন্ডার ঘিরে বছর
দুয়েক আগে অন্তত ছয়বার সংঘর্ষে জড়ান দুই নেতার অনুসারীরা। টেন্ডারকে
কেন্দ্র করে ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আবদুর রব
হলের সামনে কুপিয়ে আহত করা হয় সহ-সভাপতি তাইফুল হক তপুকে। এরপর ক্যাম্পাসের
২নং গেটে দিয়াজের বাসাসহ ছাত্রলীগের চার নেতার বাসায় তাণ্ডব ও লুটপাট
চালানো হয়। এসব কারণে ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাসে অবরোধের ডাক দেয়
ছাত্রলীগের একটি পক্ষ। এর জের ধরে ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত
দু'পক্ষের চার দফা সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফানের
মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় তার বাসা থেকে। এরপর ২ নভেম্বর ছাত্রলীগের দুই
গ্রুপের সংঘর্ষে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, হাটহাজারী থানার ওসিসহ
আহত হয় অন্তত ৬৬ জন। এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলে তল্লাশি চালিয়ে
চারটি পাইপগান, শতাধিক রামদা, বিপুল পরিমাণ রড, পাইপ ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার
করে পুলিশ। এর আগে ২০১৫ সালের জুন মাসে চবিতে ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল
হোসাইনের হাত ও পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ১১ ছাত্রলীগ কর্মীকে
গ্রেফতারও করে পুলিশ। আবার ছিনতাইয়ে যুক্ত থাকায় ছাত্রলীগের ছয় কর্মীকে
বহিস্কার করতেও বাধ্য হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
মতের অমিল হলে মাইর খাচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও :চবিতে নানা কারণেই সাধারণ
শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করে বলে অভিযোগ আছে। স্বনামে কেউ মুখ না
খুললেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একাধিক শিক্ষার্থী জানান, ফেসবুকে লেখালেখির
কারণে ও শিবির সাজিয়ে গত দুই বছরে অন্তত দুই ডজন শিক্ষার্থীকে মারধর করেছে
ছাত্রলীগ। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা আন্দোলনে
সক্রিয়দেরও মেরেছে ছাত্রলীগ। এদেরই একজন যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের
সাবেক শিক্ষার্থী ইয়াকুব রাসেল। ভারতের জনপ্রিয় রিয়েলিটি অনুষ্ঠান
মীরাক্কেলের সিজন-৯-এ অষ্টম হওয়ায় শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় ইয়াকুব
মারধরের শিকার হন গত বছরের ১২ আগস্ট। তার মাথায় ১১টি সেলাই দিতে হয়। ২০১৬
সালের মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ২০ জনকে মারধর করে শিবির সাজিয়ে
পুলিশের হাতে তুলে দেয় ছাত্রলীগ। এদেরই একজন 'প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক'
পাওয়া এমদাদুল হক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এই শিক্ষার্থী
শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে
থেকে তাকে তুলে নিয়ে দিনভর আটকে রাখে ছাত্রলীগ। তাকে মারধর করে টাকা ও
মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এরপর 'শিবিরের কর্মী' আখ্যা দিয়ে তুলে দেওয়া হয়
পুলিশের হাতে।
অপকর্মের কারণে একাধিকবার বিলুপ্ত হয়েছিল কমিটি :বারবার অপকর্ম করায় চবি
ছাত্রলীগের কমিটির কার্যক্রম বেশ কয়েক দফা স্থগিত করেছিল কেন্দ্রীয়
ছাত্রলীগ। এখন নতুন কমিটি কাজ করলেও ২০১৫ সালের ২০ জুলাই আলমগীর টিপুকে
সভাপতি ও ফজলে রাব্বী সুজনকে সাধারণ সম্পাদক করে চবি ছাত্রলীগের যে কমিটি
গঠন করা হয়েছিল, সেটি বিলুপ্ত করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। নানা অপকর্মের
কারণে এর আগের কমিটিকেও ২০১৪ সালের জুন মাসে বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয়
ছাত্রলীগ। এরপরও সংঘর্ষে জড়ান বিলুপ্ত কমিটির নেতাকর্মীরা। এমনকি এক গ্রুপ
আরেক গ্রুপকে বহিস্কারও করে। ছাত্রলীগ নেতা নাজমুলের হাত-পায়ের রগ কাটার
অভিযোগে আ জ ম নাছির উদ্দীন অনুসারী গ্রুপ মহিউদ্দিনের অনুসারী ছাত্রলীগের
ছয় নেতাকর্মীকে সংগঠন থেকে বহিস্কার করে। এটি নিয়ে তখন উত্তেজনা বিরাজ
করছিল চবিতে। চবি ছাত্রলীগের আগের কমিটিও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে
বারবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে চবিতে।
সংঘর্ষে জড়িয়েছে নতুন কমিটিও :আধিপাত্য বিস্তার নিয়ে চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে
নতুন কমিটি গঠনের পরও। এতে উভয় গ্রুপের ছয়জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। চলতি
বছরের সেপ্টেম্বরে এ সংঘর্ষের পর বিজয় গ্রুপ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের
সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের বহিস্কার দাবি করছে। এই দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে
অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ডাক দিয়েছে তারা। হোসপাইপ কেটে শাটল ট্রেন চলাচলও
বন্ধ করে দিয়েছে তারা। অপহরণ করেছে শাটল ট্রেনের চালককে। সুপারগ্লু ও পেরেক
দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে পরিবহন পুলে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি। পুলিশি
হস্তক্ষেপে পরে শান্ত হয় পরিস্থিতি। সংঘর্ষে জড়ানো ট্রেনের বগিভিত্তিক
গ্রুপগুলোর মধ্যে চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার (সিএফসি) চবি ছাত্রলীগের বর্তমান
সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের অনুসারী আর বিজয় গ্রুপ সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক
মোহাম্মদ ইলিয়াসের অনুসারী ছিল।
- বিষয় :
- শিক্ষাঙ্গনে টর্চার সেল -৩