জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইউজিসির নির্দেশনায়ও টলেন না প্রক্টর

ফাইল ছবি
ইমরান হুসাইন, জবি
প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ | ০৯:৩৩
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। তাঁর দুই বছরের মেয়াদ শেষ হলেও তাঁকে দায়িত্বে রাখায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষকদের মাঝে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা উপেক্ষা করে দায়িত্বে রাখা হয়েছে তাঁকে। পিএইচডি নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া মিথ্যা মামলায় শিক্ষার্থীদের ফাঁসানো, প্রক্টর অফিসে ডেকে নিয়ে হেনস্তা করা এবং তুচ্ছ ঘটনায় অভিভাবকদের ডেকে এনে শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
গত বছর ২০ মার্চ ইউজিসির এক বিজ্ঞপ্তিতে ১০ বছরের অধিক বয়সের বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, অর্থ ও হিসাব পরিচালক, পরিকল্পনা পরিচালকসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে চুক্তিভিত্তিক, অতিরিক্ত দায়িত্ব বা চলতি দায়িত্বের পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-প্রবিধান অনুয়ায়ী স্থায়ী নিয়োগ প্রদান করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, এ নির্দেশনা উপেক্ষা করে জবি প্রশাসন প্রক্টর মোস্তফা কামালকে দায়িত্বে রেখেছে।
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক মোস্তফা কামালকে ২০১৯ সালের ২৯ মে প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০২১ সালের ২৪ জুলাই তাঁর মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে পরদিন পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাঁকে প্রক্টর হিসেবে অনির্দিষ্টকালের জন্য দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়। এর পর দেড় বছর অতিক্রম হলেও প্রক্টরের দায়িত্বে বহাল রয়েছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি। শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, যাঁরা মেয়াদ শেষে অতিরিক্ত বা চলতি দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁদের স্থানে অন্য শিক্ষকদের সুযোগ করে দেওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিজ্ঞ অনেক শিক্ষক রয়েছেন।
এর আগে পিএইচডি নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে। পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম একাডেমিক কাউন্সিল সভায় একাধিক ডিন ও জ্যেষ্ঠ শিক্ষক এর বিরোধিতা করেন। তবে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান নিজ ক্ষমতাবলে তাঁকে এই ডিগ্রি প্রদান করেন। মোস্তফা কামালকে এই ডিগ্রি প্রদানের আগে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করতে তিন বছরের সময়সীমা ছিল। কিন্তু কম সময়ে পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার বিষয়ে জালিয়াতির খবর ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে সমকালসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এদিকে প্রক্টরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উঠতে থাকে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহল থেকে। ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'জন সহকারী প্রক্টর একটি বাসের চালক জুয়েল মিয়াকে ধরে আনেন প্রক্টর অফিসে। বাহাদুর শাহ পরিবহনের বাসের চালক জুয়েল তাঁদের রিকশাকে ধাক্কা দিয়েছেন- এ অভিযোগে কিল-ঘুসি ও লাথি মারেন তাঁরা। এ সময় তাঁদের না থামিয়ে প্রক্টর মোস্তফা কামাল গাড়িচালককে গালি দিচ্ছিলেন। পা ধরে মাফ চাইলেও জুয়েলকে এমন মারধর করা হয়, তিনি দাঁড়াতেই পারছিলেন না। খবর দেওয়ার পর পুলিশ ও সাংবাদিক সেখানে গেলে তাঁকে চিকিৎসার জন্য ৫০০ টাকা দিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
দুই বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী ডাব পাড়ায় তাঁদের প্রক্টর অফিসে নিয়ে বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রেখে নানাভাবে হেনস্তা করা হয়। তাঁদের বাসায় ফোন করে ডাব চুরি করে ব্যবসা করার অভিযোগ তোলা হয় এবং তাঁরা নেশাগ্রস্ত বলে জানানো হয়। এমনকি ডাবচোর অ্যাখ্যায়িত করে ডাকা হয় পুলিশ। শিক্ষার্থীরা ক্ষমা চাইলেও তাঁদের কেন বহিস্কার করা হবে না- জানতে চেয়ে নোটিশ দেওয়া হয়। পরে নেওয়া হয় মুচলেকা। এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৌহিদুল ইসলাম শান্ত বলেন, 'সেসব দিনের কথা ভাবলে এখনও শিউরে উঠি। ক্যাম্পাসের ফল শিক্ষার্থীরা খেলে দোষ কীসের, অন্য সব ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা খায়- এ কথা বলার পর তাঁদের ডাব ব্যবসায়ী, মাদকসেবীসহ নানা অপবাদ দেওয়া হয়। প্রক্টর মোস্তফা কামাল কখনোই শিক্ষার্থীবান্ধব ছিলেন না।'
ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ল' বিভাগের শিক্ষার্থী বাদশা (ছদ্মনাম) বলেন, 'আমাদের ব্যাচের এক শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার পর আমরা পরের দিনের পরীক্ষা পেছাতে বলেছিলাম। এ দাবি করায় কয়েকজনকে প্রক্টর অফিসে নিয়ে হেনস্তা করা হয়। আমার বাবা-মাকে ডেকে এনে অনেক কটু কথা বলেন প্রক্টর ও অন্য স্যাররা। আমার মা কান্না করতে করতে চলে গিয়েছিলেন।'
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি না থাকা অবস্থায় তুচ্ছ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের প্রক্টর অফিসে ডেকে এনে হয়রানি করার ঘটনাসহ মিথ্যা মামলা দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অধ্যাপক মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, প্রক্টর অফিসে কোনো গাড়িচালককে মারধর করা হয়নি। ডাব পাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ক্যাম্পাসের বাইরের কিছু লোক ডাব পেড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তাদের ধরা হয়েছিল, তবে শিক্ষার্থীদের কিছু বলা হয়নি। পিএইচডি নিয়ে জালিয়াতির বিষয়ে তিনি বলেন, নিয়ম মেনেই সব কিছু করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হক সমকালকে বলেন, অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিয়ম মেনেই সবকিছু হবে।