ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের কথা

নতুন উপলব্ধির সময় এখন

নতুন উপলব্ধির সময় এখন

ছবি: ফাইল

মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২০ | ১৪:৩৪ | আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২০ | ১৪:৪৬

বৈশ্বিক মাত্রায় কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনায় এটা বলার লোকের অভাব হয় না যে, এর আগের ও পরের বিশ্ব এক থাকবে না। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে নাইন ইলেভেনের হামলার পরও এমন কথা তাত্ত্বিকরা অনেকবার বলেছিলেন। পরবর্তীকালে বিশেষত বিমান চলাচল বা নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নজিরবিহীন কঠোরতা এলেও ওই ঘটনা বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলেছে, সেই প্রশ্নের মীমাংসা সহজ নয়। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ-পরবর্তী বিশ্ব যে আর আগের মতো থাকছে না, তা এখনই নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া সম্ভব। যত দিন যাবে, করোনার প্রেক্ষিতে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার রূপ ও রেখাগুলো আরও স্পষ্ট হতে থাকবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি বিশ্বমন্দা কীভাবে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে, বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে সেই আলোচনা এখনই শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিশাল বিশাল অবকাঠামো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করোনাভাইরাসের কাছে কীভাবে অসহায় প্রমাণিত হচ্ছে, প্রতিদিন প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে তাও স্পষ্ট। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যম নিজেই এই 'করোনাকালে' কীভাবে নতুনতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তা আমাদের চেয়ে কে বেশি জানে?

আমি নিজে যখন প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছি, তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে ছিল হেলথ রিপোর্টিং। এখন সম্পাদক হিসেবে যে কারণে সংবাদপত্রের জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ- সব বিষয়ে নজর রাখার পাশাপাশি দেশীয় ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার আলাদা দৃষ্টি থাকে। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, এর অবকাঠামো, জনবল প্রভৃতি বিষয়ে সমকাল অন্য অনেক সংবাদমাধ্যমের তুলনায় বেশি প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রস্তুতি, ফাঁকগুলো নিয়েও আমরা প্রায়শই সম্পাদকীয় ও বিশ্নেষণ প্রকাশ করে থাকি। একই কারণে সম্ভবত চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অনেকেই আমাদের সঙ্গে কথা বলতে স্বস্তি অনুভব করেন। এই লেখাটির পেছনেও তাদের কারও কারও ফোন অনুঘটকের ভূমিকা রেখেছে। অনেকেই তাগিদ দিয়েছেন দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্নেষণের। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে দিনের পর দিন অবহেলা, উদাসীনতার কথাও তারা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, আমাদের রথী-মহারথীরা তো সর্দি হলেও বিদেশ চলে যেতেন, দেশে চিকিৎসা নেওয়া তাদের প্রয়োজন হতো না- করোনা পরিস্থিতিতে এখন তারা কোথায় যাবেন। দেশকে যে সর্বক্ষেত্রেই স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখতে হয় নিশ্চয় এবার তাদের সেই উপলব্ধি হবে। এ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা যদি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সত্যিকার উন্নয়নে নজর দেন, তাহলেই জাতি উপকৃত হবে।

আমরা আসলে ভাবতেই পারিনি কভিড-১৯ এসে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে এভাবে অসহায় করে তুলবে। আমরা গ্রামাঞ্চলে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেছি; চিকিৎসকদের কর্মস্থলে থাকার কথা বলেছি; ওষুধ ব্যবস্থা জনমুখী করার কথা বলেছি; চিকিৎসা ব্যবস্থা জনসাধারণের হাতের নাগালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছি; কিন্তু আমরা কি জানতাম- এতদিন দিয়ে আসা সব তাগিদই খোদ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থা তথা 'সামান্য' পিপিই-র অপ্রতুলতার কাছে গিয়ে মাথা কুটে মরবে?

পিপিই নিয়ে অপ্রতুলতা কেবল নয়, অব্যবস্থাপনাও কতটা প্রকট নতুন করে বলার কিছু নেই। যতটুকু আমাদের আছে, দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন উৎস থেকে যতটুকু পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোও যেভাবে 'অপাত্রে দান' করা হয়েছে, তা একই সঙ্গে ক্ষোভের, বিস্ময়ের ও বেদনার। আমরা দেখছি, যে কোনো অসুস্থতায় আমাদের সবচেয়ে কাছে থাকেন যে পেশাজীবী, সেই চিকিৎসকদেরও কয়েকজন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসায় বেশ কিছু চিকিৎসক কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন। তাদের কাউকে কাউকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। মানুষের সেবায় তারা কতটা নিবেদিতপ্রাণ আমি জানি। পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া মানবতার সেবা করতে গিয়ে তাদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর আমাকে মর্মাহত করেছে। অথচ শুরু থেকে চিকিৎসকদের সুরক্ষা ব্যবস্থায় মনোযোগ দেওয়া গেলে এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। এখনও সময় আছে, সবার আগে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের আসলে নতুন উপলব্ধির সময় এসেছে। স্বাস্থ্য খাতে গবেষণা সম্ভবত সবচেয়ে অবহেলিত অংশ। করোনাভাইরাস প্রমাণ করেছে, ভাইরাস বা জীবাণুবিষয়ক গবেষণা কতটা জরুরি। তাৎক্ষণিক কাজে হয়তো লাগবে না, কিন্তু এখনকার মতো দুর্যোগ ও দুর্বিপাকে এসব গবেষণাই ভরসা জোগাতে পারে প্রিয় বাংলাদেশকে।

মনে রাখতে হবে, করোনাভাইরাসের প্রভাব সহজে ও সহসা শেষ হওয়ার নয়। করোনাই শেষ ভাইরাস নয়। পরিবর্তিত জলবায়ুর সামনের দিনগুলোতে আরও নতুন নতুন ভাইরাস মোকাবিলা করতে হবে মানবজাতিকে। এ ধরনের ভাইরাস দিয়ে জীবাণুযুদ্ধের যে 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' বিভিন্ন মহল থেকে তোলা হচ্ছে, সেটাও উড়িয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এর একটাই জবাব- গবেষণা ও প্রস্তুতি। প্রস্তুত জাতিই হতে পারে নতুন বিশ্বের নতুন সংকট মোকাবিলার অগ্রসেনানী। আবারও বলি- আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। নতুনতর উপলব্ধির সময় এখন।

সংবাদমাধ্যম নিয়েও নতুন উপলব্ধির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করছি- এমন পরিস্থিতির মুখে পড়ার জন্য কি আমরা প্রস্তুত ছিলাম? আগেও একটি লেখায় বলেছিলাম- আগে যেখানে সংবাদমাধ্যমের কাঠামো ও চরিত্রের পরিবর্তন শতকে শতকে ঘটত, এখন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব পরিবর্তনের কারণে আক্ষরিক অর্থেই প্রতিনিয়ত ঘটছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি পরিবর্তনের সেই প্রবাহকেও যেন পেছনে ফেলেছে। সংবাদমাধ্যম এমন এক সময়ের মুখোমুখি, যখন কেবল রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন বিষয় নয়, খোদ সংবাদমাধ্যমকে নিয়েও গুজব ছড়াচ্ছে। কয়েকদিন আগে আমরা দেখেছি- সংবাদপত্রের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানোর গুজব ছড়ানো হয়েছিল। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা ছিল সংবাদপত্রের মতো 'প্রোডাক্ট' করোনা ছড়ায় না। এমন ধারণা মৌলিক স্বাস্থ্যবিধির অন্তরায়।

পণ্যের মাধ্যমে যদি করোনাভাইরাস ছড়াত, তাহলে সবার আগে ছড়াত আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় আলু, পটোল, পেঁয়াজের মাধ্যমে। ওয়াকিবহাল মহল জানেন, আধুনিক সংবাদপত্র মুদ্রিত হয় সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। এই গুজবে ভর করে এবং কিছু অনলাইন সংবাদমাধ্যম বুঝে বা না বুঝে গুজবের পালে হাওয়া দিয়েছে। এতে করে পাঠকের মধ্যেও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে এবং বাংলাদেশে শুধু নয়, বিশ্বজুড়েই মুদ্রিত সংবাদপত্র চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াবের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সত্য তুলে ধরা হয়েছে। আমরাও নানাভাবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি। বিভ্রান্তি দূর করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। সংবাদপত্র মুদ্রণ বন্ধ করার গুজবও ছিল। সমকালসহ দেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্র সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই মুদ্রণ অব্যাহত রেখেছে। আমরা এই লড়াই অব্যাহত রাখব।

আমি বরং বলতে চাই- দুর্যোগের এই সময়ে মুদ্রিত সংবাদপত্রের উপস্থিতি আরও বেশি জরুরি। শুধু আমি নই, বিশ্বজুড়েই সম্পাদকবৃন্দ এই সত্য বিশ্ববাসীকে আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, মুদ্রিত সংবাদপত্রের উপস্থিতি কীভাবে গুজব ও ফেইক নিউজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের ৬০টি সংবাদপত্র প্রথম পৃষ্ঠায় অভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অভিন্ন শিরোনামে- 'হোয়েন ইউ আর অন ইওর ঔন, উই আর দেয়ার উইথ ইউ'। বাংলায় বললে, আপনি যখন নিজের মতো করে থাকছেন, তখনও আমরা আপনার পাশে আছি। প্রতিবেদনে তারা ঘোষণা করছে- 'আমরা জানি, নির্ভরযোগ্য সংবাদ ও তথ্যের অবিচ্ছিন্ন সরবরাহ আপনাদের আস্থা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সেই ভূমিকা পালনেরই অঙ্গীকার করছি আপনাদের কাছে। যাই ঘটুক না কেন, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি।'

প্রিয় পাঠক, শনিবার থেকে সমকালের মাস্টহেডে আপনারা একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন। করোনা সচেতনতার অংশ হিসেবেই আমরা সমকাল নামটির প্রতিটি অক্ষর আলাদা করে দিয়েছি। আর ফাঁকা জায়গাগুলোতে লিখেছি 'সঠিক তথ্য জানুন।। দূরত্ব বজায় রাখুন।। ঘরে থাকুন সুস্থ থাকুন।' বস্তুত কীভাবে এই দুঃসময়ে আরও ভালোভাবে পাঠকের পাশে থাকা যায়, সমকালসহ বাংলাদেশের মুদ্রিত সংবাদমাধ্যম সেই প্রচেষ্টাই প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছে। কেবল নির্ভরযোগ্য সংবাদ সরবরাহ নয়, ঝড়-দুর্যোগ উপেক্ষা করে পাঠকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেন যারা, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করারও উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। সমকালের পাঠক সংগঠন সুহৃদ সমাবেশের মাধ্যমে এই দুঃসময়ে আমরা চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে সামর্থ্য অনুসারে ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ পৌঁছে দিচ্ছি। খেটে খাওয়া মানুষের জন্য পৌঁছে দিচ্ছি ত্রাণ। চলছে পরিচ্ছন্নতা অভিযান। 'সেবা এক্সওয়াইজেড'-এর সঙ্গে আমরা যুক্ত হয়েছি 'মিশন সেভ বাংলাদেশ কর্মসূচি'তেও।

আমরা দেখছি, বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- সরকারের উচিত ছাপাখানা থেকে সংবাদপত্র নিয়ে পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। কারণ মুদ্রিত ও নির্ভরযোগ্য সংবাদপত্রই পারে গুজবের বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে। তা না হলে এই যুদ্ধাবস্থায় গুজবের গুবরে পোকা করোনাভাইরাস মোকাবিলার সার্বিক উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তছনছ করে দিতে পারে সামগ্রিক সুরক্ষা ব্যবস্থা। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, মুদ্রিত সংবাদপত্র এবং নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি জরুরি। এটা আমাদের নিশ্চিত করতেই হবে।

সবিনয়ে এও মনে রাখতে বলি, সংবাদপত্রের সামাজিক দায়িত্ব নতুন নয়। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, বন্যা থেকে ঘূর্ণিঝড়, উৎসবের দিনগুলো থেকে জরুরি অবস্থা- সবসময়ই সংবাদপত্র দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পাশে থেকেছে। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার সারথি হয়েছে। আমরা অঙ্গীকার করতে চাই- সমকাল আপনাদের পাশে ছিল, আছে, থাকবে। আমাদের সামনে যত বড় চ্যালেঞ্জই আসুক না কেন, পাঠক, সমাজ ও দেশের দুঃসময়ে আমরা হাল ছেড়ে দেব না।

অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়ে আমরা আপনাদের পাশে থাকব। আমরা নাজুক বিশ্বকে নতুন বিশ্বের অভিমুখে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াই নিরন্তর চালিয়ে যাব। আপনাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হোক আমাদের নতুন উপলব্ধি।

আরও পড়ুন

×