বঙ্গভবন ছেড়ে নিকুঞ্জের লেক ড্রাইভ রোডে

নিকুঞ্জের বাসায় উঠে ব্যালকনি থেকে হাত নাড়েন সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ- সমকাল
সাহাদাত হোসেন পরশ
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০
কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব পার হলেই কুড়িল ফ্লাইওভার। ওই ফ্লাইওভারে ওঠার মুখেই বাঁ পাশ ঘেঁষা ‘নিকুঞ্জ’। ছিমছাম আবাসিক এলাকা। নিকুঞ্জের লেক ড্রাইভ রোডে ৬ নম্বর বাড়ি। সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের নতুন ঠিকানা। গতকাল সোমবার সকাল থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের চোখ ওই বাড়ি ঘিরেই। বাড়ির সামনে গণমাধ্যমকর্মীদেরও জটলা। ওই বাড়িতে নেই কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী। সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতির বঙ্গভবন ছেড়ে নতুন বাসগৃহে ওঠার সব প্রস্তুতি চলছিল। পরিচয়পত্র দেখিয়ে লেক ড্রাইভ সড়কে ঢুকতে হলো। কিছু সময়ের জন্য ওই এলাকায় সীমিত ছিল সাধারণের চলাচলও।
দুপুর ২টা ১ মিনিট। প্রচণ্ড খরতাপ। হঠাৎ কানে বাজল সাইরেন। একে একে সড়কে ঢুকল আবদুল হামিদের প্রটোকলের সব গাড়ি। ধীরস্থিরভাবে গাড়ি থেকে নেমে এলেন সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাঁর সহধর্মিণী। আবদুল হামিদের পরনে নীল স্যুট-টাই, স্ত্রীর পরনে সোনালি-কালো পাড়ের শাড়ি। স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) ও অন্য শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্কাবস্থায়। গণমাধ্যমকর্মীদের নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে দায়িত্ব পালন করতে বলা হলো। গাড়ি থেকে নামার পর আবদুল হামিদকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিলেন পরিবারের সদস্যরা। ফুলের তোড়ার ওপর লেখা ‘ওয়েলকাম ব্যাক’। সরাসরি নিজের বাড়িতে না ঢুকে উপস্থিত সবাইকে কিছুটা চমকে দিয়ে অপেক্ষমাণ গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে ডেকে নেন আবদুল হামিদ। মুহূর্তে জ্বলে উঠল ক্যামেরার সব ফ্লাশ। সড়কের ওপর রোদে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন তিনি। আবদুল হামিদ তাঁর স্বভাবসুলভ বিনয় প্রকাশ করে বললেন, ‘এই রোদের মধ্যে এসেছেন, তাই আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমার যেটুকু সফলতা, এ জন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা। দেশবাসীর দোয়া ছিল আমার প্রতি। আমার এলাকার মানুষেরও দোয়া ছিল। সাংবাদিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। বিভিন্ন সময় আমি যা-ই বলছি, সেটাকে টুইস্ট না কইর্যা সত্যিকারভাবে মানুষের মাঝে প্রকাশ করেছেন। দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া আমার কাজের ব্যাপারে অন্য রকম বাধার সৃষ্টি করেননি– এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা। এই যে রোদের মধ্যে আপনারা এখানে এসেছেন, কারণ আপনারা আমাকে ভালোবাসেন।’
আবদুল হামিদ বললেন, ‘সারাজীবন সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য রাজনীতি করেছি। দেশের মানুষের কল্যাণের কথা ভেবেই রাজনীতি করেছি। দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ প্রবর্তন হোক– এটা চেয়েছি। সফল হয়েছি, এটা বলতে পারব না। আমি আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে দেশে একটা সুষ্ঠু-স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করবে। সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশও থাকবে।’
আবদুল হামিদ আরও বলেন, ‘আজ তো মাত্র বাহির হইলাম। আপনারা সময় নিয়ে শান্ত পরিবেশে আসেন। পরে বিস্তারিত কথা বলা যাবে। আমার সময়টাকে মোটামুটি তিনটা ভাগে ভাগ করেছি। একটা ঢাকা, একটা কিশোরগঞ্জ, একটা হাওর। তবে চেষ্টা করব বেশিরভাগ সময় হাওরে থাকতে।’
মিডিয়ার অবদানের কথা তুলে ধরে সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বাংলাদেশে আমার যেটকু জনপ্রিয়তা রয়েছে, সেখানে মিডিয়ার অনন্য অবদান রয়েছে।’ সংবাদকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ঢুকলেন আবদুল হামিদ। মিনিট বিশেক পরই তিনতলা বাড়ির দোতলার ছোট্ট ব্যালকনিতে এলেন তিনি। এরপর হাত নেড়ে অভিবাদন জানালেন।
জানা যায়, ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর নিকুঞ্জ-১-এর ২ নম্বর সড়কে তিন কাঠা জমি বরাদ্দ পান। ২০০০ সালের শেষের দিকে সেই জমির ওপর বাড়ির নির্মাণকাজ শুরু করেন। বঙ্গভবন ছেড়ে ওই বাড়িতে আসার উপলক্ষে এরই মধ্যে সেখানে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
এবারের একুশে বইমেলায় আবদুল হামিদের ‘আমার জীবননীতি আমার রাজনীতি’ বইটি প্রকাশিত হয়। সেখানে তাঁর শৈশব থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত তথ্য এসেছে। এর পরের দৃশ্যপট পাওয়া যাবে আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ডে। এখন আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ডে লেখার কাজ শেষ করবেন।
নিকুঞ্জের বাড়িটির ফটকে বসানো হয়েছে আর্চওয়ে। সেখানে মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। বাসার ছাদেও কড়া প্রহরা। এ ছাড়া আশপাশের বেশ কয়েকটি বাড়ির ছাদেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। আবদুল হামিদ সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সেটা প্রমাণ মিলল তাঁর নিকুঞ্জের বাড়ি দেখেও। বাড়িতে তেমন কোনো আভিজাত্যের ছাপ নেই। নতুন অতিথি হিসেবে ওই ভবনের বাসিন্দা হলেও নতুনভাবে ওই ভবনে চুনকামও করা হয়নি।
এসএসএফ সদস্যরা আবদুল হামিদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত। খিলক্ষেত থানা পুলিশের টিম ‘নিকুঞ্জ-৮৪’ বাড়ির আশপাশের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে। লেক ড্রাইভ রোডে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ডিআইজি মো. হারুন অর রশিদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ইউনিফর্ম ও সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তা নজর রাখছে।
রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পূর্ণ করায় আইন অনুযায়ী অবসর ভাতা, চিকিৎসা সুবিধাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাবেন আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতির অবসর ভাতা, আনুতোষিক ও অন্যান্য সুবিধা আইনে সাবেক রাষ্ট্রপতিরা কী কী সুযোগ-সুবিধা, কীভাবে পাবেন– তা নির্ধারণ করা আছে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে সর্বশেষ যে মাসিক বেতন পেতেন, তার ৭৫ শতাংশ হারে মাসিক অবসর ভাতা পাবেন আমৃত্যু।