টেকসই উন্নয়নে পুষ্টির চাহিদা পূরণ জরুরি

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০ মে ২০২৩ | ১৫:৫৯ | আপডেট: ১১ মে ২০২৩ | ১০:৫২
বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর ৪৫ শতাংশ ঘটে অপুষ্টির কারণে। আর উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৮০ শতাংশই বাল্যবিয়ে হওয়ায় শিশুরা মায়ের গর্ভ থেকেই ভুগছে পুষ্টিহীনতায়। অন্যদিকে, অপুষ্টির কারণে দেশে খর্বকায় শিশুর পাশাপাশি বাড়ছে স্থূলকায় মানুষের সংখ্যাও। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় একত্রিতকরণসহ পুষ্টির চাহিদা মেটানো জরুরি। এজন্য প্রশিক্ষণ, গবেষণা, পরিকল্পনা গ্রহণ ও সব ইউনিয়ন পরিষদে আলাদা পুষ্টি বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশিষ্টজন।
বুধবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল সভাকক্ষে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘শিশুর অপুষ্টি দূরীকরণে স্থানীয় সরকারের বাজেট যেমন চাই’ শীর্ষক এ বৈঠক আয়োজন করে সমকাল ও রাইটটুগ্রো কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ। রাইটটুগ্রো প্রকল্প কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যাকশন এগেইনস্ট হাঙ্গার, দ্য সেন্টার ফর ইকোনমিক গভর্ন্যান্স অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটি আফ্রিকা (সিগা), ম্যাক্স ফাউন্ডেশন, সেভ দ্য চিলড্রেন, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট, ওয়ার্ল্ড ভিশন এবং স্থানীয় সংস্থা হিসেবে রয়েছে জাগো নারী, এসডিএ এবং এইচএলপি ফাউন্ডেশন।
সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খানের সভাপতিত্বে বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু যাত্রা শুরু করেছিলেন ৯৪ ডলার মাথাপিছু আয় দিয়ে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২১ বছর পরে বাঙালির মাথাপিছু আয় হয় ৩২৯ ডলার। এখন আমাদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৯১ ডলার।
তিনি বলেন, উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে সরকার। এজন্য শিশুর অপুষ্টিহীনতা নিয়ে কাজ করতে হবে। এ কাজে সরকার বিভিন্নভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেও। পুষ্টি খাতে আলাদা বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে তিনি আলোচনা করবেন।
আবু সাঈদ খান বলেন, মায়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করাসহ পরিবার ও এলাকার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে বহুমাত্রিক উদ্যোগ দরকার। উদ্যোগটা নিশ্চয়ই সরকার বিবেচনা করবে। আমরা এগিয়েছি, আরও এগোতে চাই। এজন্য প্রয়োজন দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন।
তিনি বলেন, বাজেটের ক্ষেত্রে আগে লক্ষ্য করা যেত ওপর থেকেই এটা দেওয়া হয়। কিন্তু ইদানীং ইতিবাচক দিকও দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে প্রয়োজন ও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সরকারের কাছে, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তা তুলে ধরা হচ্ছে। এখন অবরোহী নয়, আরোহী পদ্ধতিও বিবেচনা করা দরকার।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ কার্যালয়ের মহাপরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য প্রাধান্য পেয়েছে। এখন সেই অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করাই আমাদের কাজ। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অনেকগুলো শক্তিশালী হাত আছে, এদের সক্ষমতার বিষয় আছে। সবকিছু এক দিনে সম্ভব না। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পনা প্রয়োজন।
নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিনীতির উপদেষ্টা এ কে ওসমান হারুনি বলেন, রাইটটুগ্রো প্রকল্পটি বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ৬টি দেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভালো অভিজ্ঞতাগুলো মূলধারায় নিয়ে আসা, দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে তা পলিসিতে যুক্ত ও বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ। ভালো উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের জন্য তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করাও অত্যন্ত জরুরি।
সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক তানিয়া শারমিন বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের বাজেট বরাদ্দ হয় মূলত স্বাস্থ্য খাতে। এটি শুধু পুষ্টি খাতেই নয়, পয়ঃনিষ্কাশন, বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রচারণা, পরিবার পরিকল্পনা উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। তিনি বলেন, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের পুষ্টি ও মনোসামাজিক বিকাশের দিকে নজর দিতে হবে। এর মাধ্যমে শিশুদের মস্তিষ্কের সার্বিক গঠন নিশ্চিত করা যায়। তাই পুষ্টির উন্নয়ন জরুরি। এ জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদে আলাদা বাজেট বরাদ্দ না হলে উপজেলা বা জেলায়ও আসবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজমা শাহিন বলেন, রাইটটুগ্রো প্রকল্পটি যেসব এলাকায় পরিচালিত হচ্ছে, সেসব এলাকায় ৮০ শতাংশ কিশোরীই বাল্যবিয়ের শিকার। অর্থাৎ সেখানকার প্রধান সমস্যা বাল্যবিয়ে। যেখানে মায়েদের শারীরিক বিকাশই সঠিকভাবে হয়নি, সে মায়ের গর্ভে কী করে একটি সুস্থ শিশু জন্ম নেবে? মূলত সেখান থেকেই অপুষ্টির সূত্রপাত হয়। এ জন্য খাদ্য নিরাপত্তা ও কমিউনিটি ডেভেলপ করতে হবে।
খুলনার ডুমুরিয়ার আটলিয়া ইউপির চেয়ারম্যান শেখ হেলাল উদ্দিন বলেন, তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে চাহিদার ভিত্তিতে বাজেট প্রণয়ন করছেন। আটলিয়া ইউনিয়নে ৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। সেখানে ওজন মাপার মেশিনও ছিল না। পরে রাইটটুগ্রো প্রকল্পের মাধ্যমে উঠান বৈঠক হলে মায়েরাই ওজন মাপার মেশিনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি পুষ্টি পরিস্থিতি উন্নয়নে আলাদা বাজেট বরাদ্দের দাবি জানান।
বৈঠকে মাঠ পর্যায়ের কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন রাইটটুগ্রো কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ টিম লিড ইকবাল আজাদ। তিনি বলেন, প্রত্যেক ৫ বছরের নিচের শিশু যেন তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে বেড়ে উঠার সমতা লাভ করে, সে জন্য কাজ করে যাচ্ছে রাইটটুগ্রো।
বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. বদিউল আলম মজুমদার, রাইটটুগ্রো কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশের কান্ট্রি স্টিয়ারিং কমিটির চেয়ারপারসন ইমাম মাহমুদ রিয়াদ, নিউট্রেশন ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর সাইকা সিরাজ, পানিসম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মীর আব্দুস সাহিদ, কেয়ার বাংলাদেশের সিনিয়র টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনিটর (ভ্যাকসিনেশন) মোহাম্মদ হাফিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ কার্যালয়ের পরিচালক ড. জুবাইদা নাসরীন, সেভ দ্য চিলড্রেন ম্যানেজার তাওফিকুল ইসলাম, ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দ্য রুরাল পুওরের ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মোহাম্মদ জোবায়ের হাসান ও পটুয়াখালী সদরের মরিচবুনিয়া ইউপির চেয়ারম্যান মাসুম মৃধা। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এইচএলপিএফ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট শফিকুল ইসলাম।