বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম দুর্নীতির বাসা

সাব্বির নেওয়াজ
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৩ | ১৮:০০
নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি)। আর এসবের জন্য সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. দিদার-উল-আলমকে অভিযুক্ত করেছেন তাঁর সহকর্মীরা। ক্ষমতার দম্ভে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আয়োজিত একটি একাডেমিক সেমিনার পর্যন্ত করতে দেননি বলেও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এর বাইরে বিধিবহির্ভূতভাবে বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য ভাতা গ্রহণ, জনবল কাঠামো না মেনে নিজের খেয়াল-খুশি মতো বিভিন্ন পদে নিয়োগেরও অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। শিক্ষকদের এসব অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিবকে জরুরি ভিত্তিতে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত ১৩ জুন উপাচার্য দিদার-উল-আলমের চার বছর মেয়াদ শেষ হয়। দীর্ঘ চার বছর মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কোনো কাজ না হলেও তাঁর মেয়াদ শেষের দিকে নিয়োগ বাণিজ্যের হিড়িক পড়ে। এখন তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ভিসি পদের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন বলে জানা গেছে।
নোবিপ্রবির শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকিউএসি ‘বাংলা ভাষার মর্যাদা ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক একটি অনলাইন সেমিনার আয়োজনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেও কোনো কারণ উল্লেখ না করেই ওই সেমিনার স্থগিত করে দেন উপাচার্য। পরবর্তী সময়ে গত মার্চে ‘বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন’ শীর্ষক আরেকটি একাডেমিক সেমিনার আয়োজনের অনুমতি চাইলেও তিনি তা আমলে নেননি। তিনি উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারি দিবসগুলো নিয়ম মাফিক পালন করা হলেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো একাডেমিক আলোচনা ও সেমিনারের নজির গত চার বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিয়োগপত্রের শর্ত অনুসারে উপাচার্যকে তাঁর জন্য নির্ধারিত বাংলোয় বসবাস করার নির্দেশনা রয়েছে। তবে তিনি বাংলোতে অবস্থান না করে দৈনিক ১৭০ টাকা হারে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসে ভিআইপি রুম ব্যবহার করেন। উপাচার্য বাংলো কম্পাউন্ডে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন; এমনকি পরিবারের সদস্যরা নোয়াখালী এলে তাঁরাও বাংলোতে বসবাস করেন। এর ফলে উপাচার্য একই সঙ্গে গেস্ট হাউস ও বিনা ভাড়ায় বাংলো ব্যবহার করেন। পাশাপাশি উপাচার্যের পরিবারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় ঢাকায় প্রতি মাসে ৬০ হাজার টাকা ভাড়ায় আলাদা বাসা ভাড়া করেন তিনি। এর ফলে বাংলো ভাড়া ২৭ হাজার টাকাসহ প্রতিমাসে ৮৭ হাজার টাকা সরকারি অর্থের অপচয়ের অভিযোগ রয়েছে। তবে উপাচার্য তাঁর বেতন বিবরণীতে কোনো বাড়ি ভাড়াই প্রদর্শন করেন না!
উপাচার্য হয়েও দিদার-উল-আলম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ নিজের দখলে রেখেছেন। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কোনো দায়িত্বই পালন না করে তিনি নির্ধারিত ভাতা গ্রহণ করেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা আছে; এমনকি শিক্ষার্থীদের সনদপত্রে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের স্বাক্ষর করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও উপাচার্য নিজে না করে তা উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে দিয়ে করান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ভিসি তাঁর মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে নিয়োগ বাণিজ্য শুরু করেন। তাঁর আমলে ৪১৫ জন শিক্ষক ও ২৬৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পান। এ নিয়োগে ব্যাপক বাণিজ্যকরণের অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া টাকার বিনিময়ে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি করা নেতাকর্মীরাও চাকরি পেয়েছেন। নিয়োগ বাণিজ্য করতে গিয়ে ভিসির ব্যক্তিগত দুই গাড়িচালক তাজুল ইসলাম ও মো. রাজু দুই দফায় ব্যাগ ভর্তি টাকাসহ ধরা পড়লে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তোলপাড় শুরু হয়। ওই ঘটনায় নামে মাত্র তদন্ত কমিটি গঠন হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এ ছাড়া কর্মচারী নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে উপাচার্যের উভয় গাড়ির ড্রাইভারকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উপাচার্য দায় এড়ানোর জন্য তাঁদের রেজিস্ট্রার দপ্তরের ড্রাইভার বলে উল্লেখ করেন। তবে অভিযুক্তরা বুক ফুলিয়ে চাকরি করছেন।
জানা গেছে, সরকার অনুমোদিত জনবল কাঠামো উপেক্ষা করে শিক্ষকসহ অন্যান্য নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে অস্থায়ী পদে কর্মরত প্রভাষকদের স্থায়ী করার জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও প্রায় প্রতিটি বিভাগেই শিক্ষা ছুটির বিপরীতে অনুমোদনহীন পদে ‘অতিরিক্ত শিক্ষক’ নিয়োগ করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় শুধু গত বছর বিভিন্ন বিভাগে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত ৫২ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। এই অতিরিক্ত শিক্ষকদের বেতনের ব্যাপারে হিসাব পরিচালক ও তৎকালীন কোষাধ্যক্ষের লিখিত পর্যবেক্ষণ সত্ত্বেও উপাচার্য স্থায়ী শিক্ষকদের বেতন বরাদ্দ থেকে বেআইনিভাবে অতিরিক্ত শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার নির্দেশ দেন। এ খাতে প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ টাকা বাজেটবহির্ভূতভাবে ব্যয় হচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগের এই বিতর্কিত প্রক্রিয়া শেষ করেই নতুন করে কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদেও অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়।
সরকার কর্তৃক আর্থিক কৃচ্ছ্রতা সাধনের বিশেষ নির্দেশনা থাকলেও সদ্য সাবেক উপাচার্য ড. দিদার-উল-আলম এতে কোনো কর্ণপাত করেননি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ‘জনবল কাঠামো অনুমোদন’ সাপেক্ষে নিয়োগ দেওয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন না করেই নিজের মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে দুটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১৫০ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন অধ্যাপক দিদার-উল-আলম। সর্বশেষ নিয়োগে সাবেক উপাচার্যের বাবুর্চি আবদুর রহমানের স্ত্রী, শ্যালকসহ শিক্ষকদের কারও ভাই, কারও বোন, কারও স্ত্রী নিয়োগ পেয়েছেন।
একাধিক শিক্ষক জানান, কোনো বিভাগে নতুন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির অনুমোদনের বিধান থাকলেও উপাচার্য তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। পদার্থ বিজ্ঞান এবং মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। শিক্ষক বাছাই বোর্ডে চ্যান্সেলর কর্তৃক দু’জন বিশেষজ্ঞ থাকা বাধ্যতামূলক এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক চূড়ান্ত অনুমোদন না হলেও বোর্ডের অন্য সদস্যদের নিয়ে ‘কোরাম’ পূর্ণ হওয়ার যুক্তি দিয়ে বিভাগ দুটিতে শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়। অথচ রাষ্ট্রপতির ‘অনুমোদন হয়নি’– এ যুক্তি দিয়ে গত দেড় বছর ধরে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপকের পদোন্নতি বোর্ডই বসানো হয়নি।
পছন্দের প্রার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে লজ্জাজনক নজির সৃষ্টি করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় মো. মোহাইমিনুল ইসলামের একজন প্রার্থী প্রথম স্থান অধিকার করেন; কিন্তু ওই নিয়োগ বোর্ডই বাতিল করা হয়। গত ৩ এপ্রিল ফের আইন কর্মকর্তার বাছাই বোর্ড বসলেও আগেরবার প্রথম হওয়া ওই প্রার্থীকে ইন্টারভিউ কার্ডই দেওয়া হয়নি।
নোবিপ্রবির প্রশাসনিক সূত্রগুলোও জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নকাজেও চরম স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার মারাত্মক অপ্রতুলতা রয়েছে। ২০১৯ সালের মে মাসে নিয়োগ পাওয়ার পর অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য কোনো প্রকল্পই নেননি।
জানা গেছে, নোবিপ্রবির বিদ্যমান বিভাগগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করাই যেখানে কঠিন হয়ে পড়েছে, সেখানে উপাচার্য তিনটি নতুন বিভাগ (পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান ও মৃত্তিকা বিজ্ঞান) চলতি শিক্ষাবর্ষে শুরু করেছেন। নতুন এসব বিভাগের ক্লাস শিক্ষকদের জন্য নির্মিত কোয়ার্টারে নেওয়া হচ্ছে। এতে কোয়ার্টার ভাড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থ বঞ্চিত হয়ে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়।
উপাচার্যের ব্যর্থতায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) প্রকাশিত সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির মূল্যায়নের ফলাফলে নোবিপ্রবি ১৫তম স্থান থেকে ৩৩তম স্থানে নেমে গেছে।
সূত্র জানায়, উপাচার্যের ব্যক্তিস্বার্থে কোনো কোনো কর্মকর্তাকে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। শিক্ষা শাখার উপরেজিস্ট্রার মো. জসীম উদ্দিনকে দীর্ঘদিন ধরে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি ওই কর্মকর্তাকে স্থায়ীভাবে রেজিস্ট্রার নিয়োগে নামকাওয়াস্তে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমানকে আহ্বায়ক করে এ কমিটি গঠন করায় সঠিক তদন্ত হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সবাই।
এদিকে, ভিসির পদটি আবাসিক হলেও তিনি বিগত চার বছরে ছয় মাসও ক্যাম্পাসে অবস্থান করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারি টাকায় জ্বালানি তেল পুড়িয়ে তিনি ঢাকা এবং নোয়াখালীতে আসা-যাওয়া করে গত চার বছরে কয়েক কোটি টাকার তেল অপচয় করেছেন।
এসব বিষয়ে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক দিদার-উল-আলমের বক্তব্য জানতে সমকালের পক্ষ থেকে গত এক মাস ধরে সরকারি ও ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনসহ নানাভাবে চেষ্টা করা হয়। ফোনে তাঁকে না পেয়ে তাঁর মোবাইল ফোনে, হোয়াটসঅ্যাপেও বারবার এসএমএস দিয়ে বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তিনি এসএমএস দেখলেও প্রতিউত্তর দেননি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুই দফা গিয়েও তাঁকে পাওয়া সম্ভব হয়নি। তাঁর ঢাকার বাসায় গিয়েও সাক্ষাৎ পাওয়া সম্ভব হয়নি।
- বিষয় :
- বিশ্ববিদ্যালয়
- নোবিপ্রবি
- অনিয়ম দুর্নীতি