হেরোইন বিক্রির টাকায় আঙুল ফুলে কলাগাছ

ফাইল ছবি
সাহাদাত হোসেন পরশ
প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১১ আগস্ট ২০২৩ | ০৬:১৮
জামালপুরের সরিষাবাড়ী থেকে বছর সাতেক আগে এসে নারায়ণগঞ্জের বন্দরে বসবাস শুরু করেছিলেন হতদরিদ্র সীমা বেগম ও তাঁর স্বামী মিন্টু মিয়া। সংসারে টানাপোড়েন লেগেই থাকত। এক পর্যায়ে বৈধপথে অভাব ঘোচানোর বদলে স্বামী-স্ত্রী মিলে গড়ে তোলেন মাদকচক্র। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের কয়েকটি সীমান্ত এলাকা থেকে হেরোইন এনে নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও আশপাশের এলাকায় পাইকারি এবং খুচরা বিক্রি শুরু করেন। বিশ্বস্ত লোক দিয়ে বন্দর থেকে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হতো মাদক। সেই টাকা দিয়ে দরিদ্র সীমা ও মিন্টু একসময় আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন জেলায় মালিক হন নামে-বেনামে প্রচুর সম্পত্তির।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মানি লন্ডারিং ইউনিট ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এই দম্পতির ব্যাপারে তদন্ত করে আলাদাভাবে। এতে উঠে এসেছে, সীমা ও মিন্টুর আয়ের বৈধ কোনো উৎস নেই। তারা যেসব সম্পদ অর্জন করেছেন, তার পুরোটা মাদক কারবারের অর্থ দিয়ে কেনা। সম্প্রতি এই দম্পতির বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করেছে সিআইডি।
তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মোকছেদুর রহমান জানান, নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকা থেকে আশপাশের ৭-৮টি জেলায় হেরোইন, ইয়াবা ও গাঁজা বিভিন্ন চক্রের কাছে পাঠাত স্বামী-স্ত্রী। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও আছে। এই দম্পতির আয়ের কোনো বৈধ উৎস নেই। মাদক কারবারের অর্থ দিয়ে তারা কী কী সম্পদ করেছেন, তা বের করার জন্য তদন্ত করেছি। তবে তাদের বিরুদ্ধে মাদক কারবার অভিযোগের মামলার তদন্ত হচ্ছে আদালাভাবে।
সিআইডি সূত্র জানায়, সীমা ও মিন্টু চক্রের সঙ্গে ১০-১২ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন বিল্লাল সরকার, রুমি বেগম, ফজর ও খাদেম। রাজশাহীর সদর এলাকার জয়নাল মিয়া নামে একজনের কাছ থেকে নিয়মিত হেরোইনের চালান এই দম্পতির কাছে আসত। চক্রের ক্যাশিয়ার হলেন বিল্লাল। মাদক কেনাবেচার পর তাঁর মাধ্যমেই টাকা লেনদেন হয়। মোবাইল ব্যাংকিং ছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যমে মাদকের অর্থ স্থানান্তর করতেন বিল্লাল।
তদন্তে উঠে এসেছে, মাদক বিক্রির অর্থ দিয়ে নারায়ণগঞ্জ বন্দর এলাকায় এই দম্পতি ১২ শতাংশ জমি কিনেছেন। সেই জমির ওপর বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া বন্দর এলাকায় তাদের আরও তিনটি আধাপাকা ঘর রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও আরও কয়েকটি জায়গায় তারা নামে-বেনামে জমি কিনেছেন। বিশদ তদন্তে এসব জমি ও সম্পদের বিষয়ে তথ্য উঠে আসবে। সিআইডি বলছে, রাজধানীর উপকণ্ঠের এই মাদক চক্রটির কাছে নগদ লাখ লাখ টাকা রয়েছে। ২০২১ সালের ২০ অক্টোবর অভিযান চালিয়ে এই চক্রের সদস্য বিল্লালের কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা জব্দ করা হয়।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের যেসব জেলার মাদক কারবারিরা নিয়মিত সীমা ও মিন্টুর কাছ থেকে হেরোইন কেনেন, তাদের কয়েকজনের নাম-ঠিকানা পেয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া চক্রটির অর্থ লেনদেনের নেটওয়ার্ক সম্পর্কেও জানা গেছে। তবে তদন্তের এ পর্যায়ে তা নিয়ে প্রকাশ্যে সিআইডির কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তবে তারা জানিয়েছেন, এই চক্রের আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে গোয়েন্দা জাল পাতা হয়েছে। সীমান্ত এলাকা থেকে যারা তাদের কাছে হেরোইন পাঠাচ্ছে, তাদের মধ্যে কয়েকজন দেশের বাইরে রয়েছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে মাদক ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তার কেন্দ্রস্থল নারায়ণগঞ্জ। কক্সবাজার, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বিভিন্ন কৌশলে মাদক এনে প্রথমে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্পটে রাখা হয়। এর পর তা সুবিধাজনক সময়ে ঢোকানো হয় ঢাকায়। নারায়ণগঞ্জের ওপর দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক গেছে। তা ছাড়া ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের রয়েছে নৌ যোগাযোগ। তাই সীমান্তবর্তী দুই জেলা কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে দেশে যে মাদক ঢুকছে, সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে নারায়ণগঞ্জকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছে মাদক কারবারিরা।
মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে আসা ইয়াবার চালানও এই জেলায় ঢুকছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নারায়ণগঞ্জের মাদক কারবারিদের একটি তালিকাও সম্প্রতি করেছে। এতে নারায়ণগঞ্জ সদরে ১৭৬ জন, ফতুল্লা থানায় ১০৯, সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ৯৯, বন্দর থানায় ৬০, রূপগঞ্জ থানায় ৩৮, আড়াইহাজার থানায় ২১ এবং সোনারগাঁও থানা এলাকার ১৭ জন মাদক কারবারির নাম রয়েছে।