ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

হার্টের রিং ব্যবসায় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট পরিচালকের স্ত্রী

হার্টের রিং ব্যবসায় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট পরিচালকের স্ত্রী

তবিবুর রহমান

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২২ আগস্ট ২০২৩ | ০৩:৩৯

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইসিভিডি) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিনের স্ত্রী খুরশীদ জাহান এইচআরএস কার্ডিয়াক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির চেয়ারম্যান হয়েছেন। কোম্পানিটি হার্টের রিং ও পেসমেকার ব্যবসায় যুক্ত। অভিযোগ উঠেছে, সরকারি চাকরির বিধিমালা লঙ্ঘন করে এনআইসিভিডি পরিচালক তাঁর স্ত্রীর মাধ্যমে হার্টের রিং ও পেসমেকার ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন।

এইচআরএস কার্ডিয়াক ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহাবুবুর রহমান ডালিম, তাঁর স্ত্রী মাসুমা আক্তার ও হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের ওয়ার্ড মাস্টার হাসানুজ্জামান টিপুর স্ত্রী ফেরদৌসী আক্তার কোম্পানিটির পরিচালক। মাহাবুবুর রহমান ডালিম এ বছরের শুরুর দিকে এইচআরএস ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির নামে বাংলাদেশে হার্টের রিং ও পেসমেকার সরবরাহকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ম্যাট্রোনিক বাংলাদেশ লিমিটেডের ডিলারশিপ নেন। এতে ২ থেকে ৩ কোটি টাকা লাগে। এ ঘটনায় আর্থিক সংকটে পড়লে এইচআরএস ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির অধীনে তিনি এইচআরএস কার্ডিয়াক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামে একটি সাব-কোম্পানি খোলেন। এখানেই চেয়ারম্যান করা হয়েছে এনআইসিভিডি পরিচালকের স্ত্রী খুরশীদ জাহানকে।

হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডালিম গত মে মাসে এইচআরএস ইন্টারন্যাশনালের অধীনে নতুন কোম্পানিটি খোলেন। ডিলারশিপ নিতে তাঁকে মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। এই বিনিয়োগের একটি বড় অংশ আসে ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মীর জামাল উদ্দিনের স্ত্রীর কাছ থেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে মাসে ২০০ থেকে ২৫০ হার্টের রিং এবং ৩০০ পেসমেকার পরানো হয়, যার প্রায় অর্ধেক নেওয়া হয় ম্যাট্রোনিক বাংলাদেশ লিমিডেট থেকে। প্রতিটি রিংয়ের দাম পড়ে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৮২ হাজার টাকা। দেশের অনেক বড় বড় হাসপাতালও এই কোম্পানি থেকে হার্টের রিং ও পেসমেকার নেয়। এইচআরএস কার্ডিয়াক ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান খুরশীদ জাহান মূলত গৃহিণী।

ডালিম এক সময় হার্টের রিং ও পেসমেকার সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং বিভাগে কাজ করতেন। তাঁর স্ত্রী মাসুমা আক্তার ও ওয়ার্ড মাস্টার হাসানুজ্জামান টিপুর স্ত্রী ফেরদৌসী আক্তারও গৃহিণী। ইনস্টিটিউটের একাধিক চিকিৎসক বলেন, নতুন কোম্পানিতে পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ করেছেন ডা. মীর জামাল উদ্দিন, যা সরকারি চাকরির বিধিমালার লঙ্ঘন। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার ১৭ (১) ধারায় বলা আছে, ‘এই আইনের অন্য বিধান অনুসারে, কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যবসায় জড়াতে পারবেন না। অথবা দায়িত্বের বাইরে অন্য কোনো কাজ কিংবা চাকরি নিতে পারবেন না।’ আবার বিধিমালার ১৭ (৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া একজন সরকারি কর্মচারী তাঁর এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় নিজের পরিবারের কোনো সদস্যকে কোনো ধরনের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার বিষয়ে অনুমতি দিতে পারবেন না।’

ম্যাট্রোনিক বাংলাদেশ লিমিটেডের নীতিমালায়ও উল্লেখ রয়েছে, যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালে এই কোম্পানির রিং বা পেসমেকার ব্যবহার হবে, সেখানকার কোনো কর্মকর্তা ও তাঁর পরিবারের সদস্য ম্যাট্রোনিকের ডিলারশিপ নিতে পারবেন না। কোম্পানি খুলে ব্যবসা শুরু করার কথা স্বীকার করেছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালকের স্ত্রী খুরশীদ জাহান। সমকালকে তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে একটি কোম্পানি খুলেছি এবং ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছি।’ তবে কত টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসা শুরু করেছেন, তা বলতে রাজি হননি তিনি।

ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মীর জামাল উদ্দিনও এইচআরএস কার্ডিয়াক ইন্টারন্যাশনালে তাঁর স্ত্রী যুক্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সমকালকে তিনি বলেন, ‘একটি কোম্পানি খুলেছি, তবে কোনো বিনিয়োগ করিনি। চাকরি শেষে হয়তো ব্যবসা শুরু করতে পারব।’

তিনি বলেন, ‘ডিলারশিপ এইচআরএস ইন্টারন্যাশনালের নামে নেওয়া, নতুন কোম্পানির নামে নয়। কিছু মানুষ শত্রুতা থেকে আমার বিরুদ্ধে এমন প্রচারণা করছে।’ মাহাবুবুর রহমান ডালিম বলেন, ‘খুরশীদ জাহান আগ্রহ দেখানোয় তাঁকে এইচআরএস কার্ডিয়াক ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান করা হয়েছে।’ আইন লঙ্ঘন করে যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যবসায় জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০২১ সালে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিঠি দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

এতে বলা হয়, অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্য অনুমোদন ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, এটা নিয়মবহির্ভূত। প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধ বিষয়ক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘হাসপাতালটির পরিচালক সরকারি আইন লঙ্ঘন করছেন, তিনি প্রতিষ্ঠানের ক্রয় নীতিমালা অনুসরণ করেননি। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়ে নিজের স্বার্থে এমন করতে পারেন না। এটি অবশ্যই অনিয়ম ও দুর্নীতি।’ এ কাজে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে, গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটকে সাড়ে ৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে এই অর্থে গরিব রোগীদের চিকিৎসায় হার্টের রিং ও পেসমেকার কেনা শুরু হবে। পরিচালকের স্ত্রীর কোম্পানি এইচআরএস কার্ডিয়াক ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে ম্যাট্রোনিক থেকে ওই রিং ও পেসমেকার কেনা হতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

আরও পড়ুন

×