বিশেষ লেখা
অস্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি ও ভুবন শীলের জীবন

ফারুক ওয়াসিফ
প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
মাথায় গুলি লাগার পরও কি শান্তি পেলেন ভুবন চন্দ্র? হাসপাতালের আইসিইউতে অজ্ঞান ছিলেন সাত দিন। মানুষটা অজ্ঞান, কিন্তু তাঁর মস্তিষ্কের ৪ শতাংশ তখনও সজাগ। কী চলছিল তখন তাঁর সজ্ঞান ৪ শতাংশ মনে? তিনি কি কিশোরী মেয়ে ‘ভূমিকা’র কথা ভাবছিলেন? তিনি মরে গেলে ওর কী হবে? স্ত্রী রত্নার কথা? যিনি নাকি স্বামীর নিথর দেহের সামনে নাওয়া-খাওয়া ফেলে দিনরাত কাঁদতে থাকলেন? মেয়েকে নিয়ে পড়ে থাকবেন হাসপাতালের সিঁড়িতে, বারান্দায়? আর বলবেন, ‘আমার মেয়েটা বাবাকে ছাড়া কিছু বুঝত না। আজ তার বাবা নীরবে চলে গেল। আমার মেয়েটা এত অভাগা, তার ছোট ছোট স্বপ্নও আর পূরণ হলো না।’ তারপর এই নারী, এই মা, এই স্ত্রী নীরবে সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেলবেন। হিন্দু বিধবার দুঃসহ জীবনে আটকে পড়বেন।
ভুবনের মস্তিষ্কের ওই ৪ শতাংশ স্ত্রী-সন্তানের এই অসহনীয় দুর্ভাগ্যের কথাই কি ভেবে চলছিল? নাকি তাঁর মস্তিষ্ক প্রাণপণে বুঝতে চাইছিল, ‘কী দোষে কার অপঘাতে আমি মারা যাচ্ছি? আমি তো আর সব দিনের মতো ক্লান্ত দেহে ঘরে ফিরছিলাম। তারপর একটা শব্দ। ও কীসের শব্দ? হঠাৎ কী ঘটল প্রতিদিনের চলাচলের রাস্তায়!’
হায় ভুবন চন্দ্র শীল, আপনি নাই হয়েও আছেন। আপনার মেয়ে বলেছে তার মাকে, ‘বাবার সঙ্গে তীর্থস্থানে যাওয়া হলো না। কিন্তু বাবার আত্মা সব সময় আমার সঙ্গে থাকবে।’ভুবন শীল মরে গেলেন, কিন্তু জানতেও পারলেন না কীভাবে মারা গেলেন, কার গুলিতে মারা গেলেন। ঘটনার সাত দিন পর আমরাও জানি না, কারা তাঁকে গুলি করেছিল? খুনের মামলার আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুন কেনই বা নির্বাচনের আগের এই সময়ে জামিনে মুক্ত হবে? আর কেনই বা তার প্রতিপক্ষ ঠিক রাজধানীর বুকে, আইনশৃঙ্খলার খাস এলাকায় এভাবে এলোপাতাড়ি গুলি করে মানুষ হত্যা করবে? আর এতদিন পরেও পুলিশ তাদের টিকি ছোঁয়া দূরে থাক, ওই ঘটনার কোনো ভিডিও ফুটেজ থেকে আসামি শনাক্ত করতে পারবে না?
জীবিত ভুবন চন্দ্র শীল ঢাকা শহরের ৮০ ভাগ রোজগেরে মানুষের মতোই ছিলেন। সারাদিনের ধকল শেষে তাদের শুরু হতো ঘরে ফেরার যুদ্ধ। দীর্ঘ যানজটে আয়ুক্ষয় করে, বৃষ্টির দিনে দরিয়া হয়ে ওঠা সড়কে যুদ্ধ করে, দুর্মূল্যের বাজারে প্রাণখানি হাতে নিয়ে ঘরে ফেরা ছাড়া আর কী আছে ঢাকা শহরের মানুষের?
ভুবন চন্দ্র শীল ঢাকার মেসবাসী আর সকল পুরুষের মতোই; একা থাকতেন। হয়তো নিজেই রান্না করে খেতেন। একাই ঘুমাতেন। স্ত্রী-কন্যাদের সুখের জন্য খেটে মরতেন। তিনি ছিলেন একটা ব্যবসায়ী কোম্পানির আইনি পরামর্শক। স্ত্রী রত্না রানী শীল নোয়াখালী মাইজদীর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কন্যা ভূমিকা রানী শীল কেবল এসএসসি পাস করেছে। জীবন তাদের দূরে দূরে রেখেছিল, মৃত্যু একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দিল।
এই শহর ঢাকার শহর এখন মরার শহর হয়েছে। যেদিন ভুবন শীল গুলি খেলেন, তার পরদিনই জলাবদ্ধ রাস্তায় পড়ে থাকা বিদ্যুতের তারে লেগে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকার রাস্তায় শান্তিতে অশান্তিতে গোলাগুলি হয়। যেমন ২০১৫ সালে ইস্কাটনে এক মদ্যপ এমপিপুত্রের গুলিতে এক রিকশাচালকসহ দু’জন নিহত হন। গত আগস্ট মাসেই বিজিবি আর মাদক কারবারিদের বন্দুকযুদ্ধে পড়ে নিহত হন এক রোহিঙ্গা শরণার্থী। গুগল সার্চ করে দেখুন, বছরে কয়েকটি করে ঘটছেই। রাজনৈতিক হানাহানির মৌসুমে এ রকম মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে। জানি না, কেউ এসব মৃত্যুকে আমেরিকা হয়ে যাওয়ার লক্ষণ বলবেন কিনা। বিশ্বের উন্নত ও ধনীতম দেশ আমেরিকায় প্রায়ই রাস্তাঘাটে নির্বিচার গুলিতে অনেক মানুষ মারা যান। হয়তো হতাশা কিংবা বন্য জেদ থেকে এসব ঘটে সে দেশে। তার সঙ্গে তুলনা করে কেউ বলতেই পারেন, পথচারী ভুবন শীলের মৃত্যু প্রমাণ করে আমরাও আমেরিকার কাতারে উঠে গেছি।
কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের বিখ্যাত একটি গল্প ভূষণের একদিন। সেটা একাত্তর সাল। গরিব কৃষক ভূষণ ছেলে হরিদাসকে খুঁজতে বেরিয়েছে। ছেলেটা কাজে ফাঁকি দিয়ে হাটে আড্ডা দিচ্ছে কিনা দেখতে দেখতে যেই ভূষণ নৌকাটা ঘাটে বেঁধে হাটে উঠে এলো, অমনি পাকিস্তানি সেনাদের গুলি শুরু হয়। ভূষণ দেখে, ছেলে হরিদাস পড়ে যাচ্ছে। ভূষণ তার কাছে যেতে গিয়ে নিজেও গুলি খায়। ছেলের শোকের যন্ত্রণার অবসান হয় মৃত্যুতে। কিন্তু এখন তো দেশে কোনো যুদ্ধ চলে না। এখন কেন এভাবে গুলিতে মারা পড়বে নিরীহ মানুষ। ভুবন শীলের বোধের মুক্তি ঘটেছে মৃত্যুতে। আমরা যারা জীবিত আছি, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি না থাকার যে আতঙ্ক, সেই বোধ থেকে আমাদের মুক্তি আসবে কীভাবে?