ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

সুশীল সমাজকে কণ্ঠ আরও উঁচু করতে হবে

সুশীল সমাজকে কণ্ঠ আরও উঁচু করতে হবে

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ০৪:৪৪

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, সুশীল সমাজকে আরও কণ্ঠ উঁচু করতে হবে। জনগণকে সংগঠিত করে তাদের কথা বলার সুযোগ করে দিতে হবে। রাষ্ট্রের সম্পদ সমভাবে বণ্টন হচ্ছে কিনা, পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কতটুকু বরাদ্দ– তার শুধু সংখ্যা দিলে হবে না। কাকে কোথায় কীভাবে দেওয়া হবে, সে প্রশ্নের উত্তর থাকতে হবে। তবে সত্যিকারের গণতন্ত্র যদি না থাকে, সংসদ যদি বেশির ভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল না হয়– তাহলে এটি নিশ্চিত করা যাবে না। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়া থাকতে হবে। সোমবার ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন   আখ্যান ও সমান্তরাল বাস্তবতা’ শীর্ষক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাবনার ওপর প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন এবং সংলাপ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।

 তিনি বলেন, জনগণকে পছন্দ করতে দিতে হবে, তারাই নেতৃত্ব বেছে নেবে। শুধু সংবিধান নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হলে বাংলাদেশকে কোনো অবস্থাতেই ‘পাকিস্তান’-এর প্রতিলিপি করা চলবে না। গড়পড়তা উন্নয়ন নয়, ন্যায্যতাভিত্তিক বাংলাদেশই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এটিই স্বাধীনতা লাভের মূল উদ্দেশ্য।

বিভিন্ন জেলার প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে আলোচনায় পাওয়া মতামত নিয়ে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এ বই প্রকাশ করেছে। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে এ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে রেহমান সোবহান বলেন, ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য নেতৃত্বে যারা আছেন বা আসতে চান, তাদের জনগণের কথা শুনতে হবে। স্বাধীনতার পাঁচ দশকে দেশের যে কিছু উন্নয়ন হয়নি, তা নয়। লম্বা সময় ধরে বড় প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে। এটি ছোটখাটো ব্যাপার নয়।

তিনি বলেন, দেশে অবকাঠামোর উন্নয়নের দরকার আছে। তবে এর উপযোগিতার মূল্য কতটুকু, সে বিষয়ও ভাবতে হবে। দেশে মেট্রোরেল হচ্ছে; অনেক ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও ব্রিজ হচ্ছে। এর মূল্য পিছিয়ে পড়া দরিদ্র মানুষও কিন্তু দিয়েছে। কিন্তু এর ফল তারা পাচ্ছে না। বছরে ৬ লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট থেকে তারা কতটা পাচ্ছে? দলিত, চা বাগানের শ্রমিক, আদিবাসী ছাড়া সরকারি হিসাবে অতিদরিদ্র ৫ শতাংশ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কি এ পরিমাণ অর্থ আমরা খরচ করতে পারি না যে তারা একসময় বলবে, ‘আমাদের আর সমস্যা নেই।’ দেশের মানুষের কর্ম ও খাদ্য পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার। এ অধিকার কি সবার জন্য বাস্তবায়ন করা গেছে? তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংসদ পর্যন্ত যাদের ওপর সম্পদ বণ্টনের দায়িত্ব, তারা যদি পিছিয়ে পড়া মানুষের দিকে যথাযথ দৃষ্টি না দেন, তাহলে তো এ ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলা যাবে না।

রেহমান সোবহান বলেন, একটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতার দুটি দিক আছে। একটি হচ্ছে গণতান্ত্রিক ব্যর্থতা, যেখানে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার থাকে না। আরেকটি হচ্ছে ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার অভাব। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে স্বাধীনতার পাশাপাশি ন্যায়ভিত্তিক সমাজও প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়ন আখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। এখানে উন্নয়ন আর বাস্তবতা সমান্তরালে দূরত্ব রেখে চলছে। এ দূরত্ব কমাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা দরকার। কিন্তু সেই রাজনীতি কোথায়? এখনকার রাজনীতিবিদদের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ নেই, কথা হয় না।

এ সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সম্পর্কে আক্ষেপ করে সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমারই নির্বাচনী এলাকার মানুষ, আমরা যখন পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে গেলাম, অত্যন্ত স্নেহের পাত্র আমার, মেয়র তাপস; ছোটবেলা থেকে দেখেছি, কারণ, একই পাড়ায় থেকেছে। আমরা সবাই যখন পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে গেলাম, তিনি বললেন যে, যদি বেশি কথা বলে ধোলাইখালে নিয়ে চুবাব।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল মনে করেন, চুবানোর সংস্কৃতি কিন্তু শেখ ফজলে নূর তাপসের একার মধ্যে নেই। অনেকের মধ্যেই আছে। এমন কথা আরও অনেক জায়গায় শুনেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন কথা বলতে গেলে যদি চুবানোর ধমক খেতে হয়, আসলে কোন রাজনীতিকের কাছে যাব?’ তিনি বলেন, আমাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এই উন্নয়নের মধ্যেও আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নির্বাচনী ইশতেহারে এত ভালো কথা বলা আছে, যার তুলনা হয় না। কিন্তু তার বাস্তবায়ন নেই। সুলতানা কামাল বলেন, এখন কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন অনেকে। নিজেদের এ চেতনার ধারক-বাহক বলে পরিচয় দেন। সময় এসেছে, তাদের বলতে হবে, মুক্তিযুদ্ধ এবং এর চেতনার পক্ষে প্রমাণ দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের উন্নয়ন মেগা প্রকল্পে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে কিনা, ভাবতে হবে। উন্নয়ন শুধু বস্তুগত উন্নয়ন দিয়ে হয় না। সরকারি হিসাবে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা যে হারে কমেছে, সে হারে হতদরিদ্রের হার কমেনি। গ্রামে বৈষম্য বেড়েছে। এটি কভিড মহামারি বা ইউক্রেন যুদ্ধ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, গড়পড়তা উন্নয়নে প্রান্তিক মানুষের লাভ হয় না। উন্নয়ন হচ্ছে বটে, তবে তার ভাগিদার সবাই নয়। কয়েক দশকের উন্নয়ন হয়েছে সরকারের বিনিয়োগে, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে নয়। প্রবৃদ্ধির অঙ্ক বড় হয়েছে; কিন্তু সরকারের রাজস্ব আয় বাড়েনি। তাহলে এটি কেমন প্রবৃদ্ধি হলো? আর প্রবৃদ্ধি দিয়ে কি দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া যায়? চলতি উন্নয়নের জন্য দেশে ঋণের বোঝা বেড়েছে, যা সামাজিক সংকটও তৈরি করেছে। দেশের মূল্যস্ফীতি এখন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় জবাবদিহি না থাকায় দুর্নীতি বেড়েছে। সুষম উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রের উত্তরণ দরকার। এটাই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। উন্নয়নের দ্বিতীয় পর্যায়ে যেতে নির্বাচন ব্যবস্থায় জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গড়পড়তা উন্নয়নের ধারা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের উন্নয়ন সামষ্টিক দিক বিবেচনায় অনেক ভালো; কিন্তু ব্যষ্টিক বিবেচনায় অন্য রকম। সরকারি পরিসংখ্যান বিভাগ বিবিএসের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে ৫ শতাংশ মানুষের সম্পদ ছিল ৩০ গুণ; এখন তা বেড়ে ৮০ গুণ হয়েছে। এমন বৈষম্য নৈতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক– কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এমন হওয়া উচিত, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং পরিবেশের জন্য সংকট তৈরি করবে না।

নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, দেশের উন্নয়নের রূপকল্প তৈরি করছেন আমলারা। মুখস্থবিদ্যায় পাস করা আমলারা পরিকল্পনাবিদ, অর্থনীতিবিদদের বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন। আজকের সামাজিক সমস্যাগুলো রাজনৈতিক সমস্যা থেকে সৃষ্ট। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবে না হলে কোনো সমস্যারই সুষ্ঠু সমাধান হবে না। উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সম্পর্ক নেই বলে মনে করেন ব্যবসায়ী সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দরকার বেশি। কিন্তু চার লাখ কারিগরি শিক্ষার্থীর জন্য সরকারের বরাদ্দ মাত্র ৮ কোটি টাকা। এ টাকা দিয়ে কী হবে– প্রশ্ন তাঁর। উন্নয়নের জন্য আমাদের নীতির অভাব নেই, তবে দুর্নীতি সব গ্রাস করছে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বিচারপতি মো. আবদুল মতিনও তাঁর বক্তব্যে দেশে এত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।   

আরও পড়ুন

×