ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট

বেশি উচ্চতার শিশুদের প্রতি এ কেমন বৈষম্য

বেশি উচ্চতার শিশুদের  প্রতি এ কেমন বৈষম্য

সাব্বির নেওয়াজ

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলমান ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নিতে পারছে না বেশি উচ্চতাসম্পন্ন শিশুরা। তাদের খেলা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের নামে এ টুর্নামেন্ট দুটির নামকরণ করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তৈরি খেলোয়াড় বাছাই নীতিমালার কারণে লম্বা শিশুরা খেলায় অংশ নিতে পারছে না। তাদের মধ্যে হতাশা নেমে এসেছে। এ নিয়ে শিক্ষকরা বিস্মিত, অভিভাবকরাও ক্ষুব্ধ। অভিভাবকদের বক্তব্য, প্রাথমিকের শিশুদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজ হতে পারে না।

শিশুদের উৎসাহ দিতেই এ দুটি টুর্নামেন্টের চূড়ান্ত আসরে প্রতিবছর নিজে উপস্থিত থেকে শিশুদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর হাত থেকে পুরস্কার পাওয়া প্রাথমিকের প্রত্যেক শিশুর পরম চাওয়া। অথচ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কারণে প্রাথমিকের বেশি উচ্চতার শিশুদের সে আকাঙ্ক্ষা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে।

জানা গেছে, তৃণমূল থেকে মানসম্পন্ন ও উদীয়মান খেলোয়াড় খুঁজে বের করতে ১৩ বছর আগে ২০১০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেশিশুদের নিয়ে চালু হয় ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট’। পরের বছর মেয়েশিশুদেরও অন্তর্ভুক্ত করে ‘বঙ্গমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট’ চালু হয়। দেশের ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২০ লক্ষাধিক ছেলে ও মেয়ে খেলোয়াড় এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হলেও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একশ্রেণির আমলার তৈরি করা নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এ টুর্নামেন্ট থেকে ভবিষ্যতের সম্ভাব্যময় খেলোয়াড় বের করে আনা যাচ্ছে না।

শুধু মেয়েদের একটি দল এখন পর্যন্ত সুনাম কুড়িয়েছে। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েশিশুরা তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ে উঠে এসেছে। এই স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করার ঘটনা ফুটবল নিয়ে আশাজাগানিয়া। পাশাপাশি সারাদেশ থেকে নারী খেলোয়াড় জাতীয় পর্যায়ে উঠে না আসার আক্ষেপও তৈরি হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ দুটি ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরুর এক যুগ পার হয়ে গেলেও জাতীয় দল এখনও মানসম্পন্ন কোনো খেলোয়াড় পায়নি এই টুর্নামেন্ট থেকে। দুটি কারণে ভবিষ্যতেও জাতীয় দলের জন্য খেলোয়াড় না পাওয়ার অনেক কারণ তৈরি হয়েছে বলে টুর্নামেন্ট-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, শিক্ষক, অভিভাবক ও খুদে খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো খেলোয়াড় বাছাই নীতিমালা। লম্বা শিশুদের এ খেলা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে; অন্যটি অর্থ সংকট।

জানা যায়, এই টুর্নামেন্টের জন্য তৃণমূল পর্যায়ে নামমাত্র অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে। এই টুর্নামেন্ট খেলার জন্য স্কুলপ্রতি বরাদ্দ মাত্র দুই হাজার টাকা। এই টাকায় ইউনিয়ন পর্যায়ের খেলা কোনোরকমে চালিয়ে নেওয়া গেলেও ইউনিয়ন পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন দলগুলো উপজেলা, জেলা, বিভাগ বা জাতীয় পর্যায়ে খেলতে গেলে আর্থিক সংকটে পড়ে। আবার দল হেরে গেলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের চাপ দেয়, যেন পরের ধাপে খেলতে না চায়। এভাবে শিশুদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে স্কুলগুলোর জন্য সরকারি পর্যাপ্ত বরাদ্দ চান শিক্ষক ও কর্মকর্তারা।

সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অন্তত ১০ জন প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়েছে সমকালের। তারা জানান, এই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বড় অসংগতি হলো খেলোয়াড় বাছাইয়ে লম্বা শিশুদের বাদ দেওয়া।

টুর্নামেন্টের নীতিমালা অনুযায়ী, খেলোয়াড়দের বয়স হবে সর্বোচ্চ ১২ বছর এবং উচ্চতা হতে হবে ছেলেদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ ফুট এবং মেয়েদের সর্বোচ্চ ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি।

নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার সেনবাগ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী জারিন বিনতে জাফরের জন্মনিবন্ধন অনুযায়ী বয়স ১০ বছর হলেও তার উচ্চতা ৪ ফুট ১১ ইঞ্চির সামান্য বেশি। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে খেলতে পারলেও জেলা পর্যায়ে এসে উচ্চতার অজুহাতে তাকে আর খেলতে দেওয়া হয়নি। নোয়াখালী শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সমকালকে সে জানায়, মাপে উচ্চতা সামান্য বেশি হওয়ায় তাকে বাছাই কর্তৃপক্ষ বাদ দিয়েছে। দল জিতলেও সে খেলতে পারেনি। আক্ষেপ করে জারিফা বলে, লম্বা হওয়া কি অপরাধ?

দেখা গেছে, ছেলেদের ক্ষেত্রেও উচ্চতা পাঁচ ফুটের বেশি হওয়ার কারণে অনেকেই খেলতে পারেনি। দলের সেরা খেলোয়াড়ও বাদ পড়ছে উচ্চতার কারণে।

বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন সমকালকে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ। তবে উচ্চতার বিষয়টি আরও শিথিল করা দরকার। তাহলে আরও মানসম্পন্ন খেলোয়াড় উঠে আসবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উচ্চতার সুযোগ নিয়ে অনেক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবার বেশি বয়সী খাটো খেলোয়াড়দের মাঠে নামিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে একজনের জন্মনিবন্ধন দিয়ে আরেকজন কম উচ্চতার বেশি বয়সী খেলোয়াড় মাঠে নামে।

রাজধানী ঢাকার দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, এ বছর বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ শুরু হয়েছিল গত এপ্রিল মাসে। মাঝখানে তীব্র গরমের কারণে অনেক দিন খেলা স্থগিত রাখা হয়। ফলে এই তিন-চার মাসে শিশুদের উচ্চতাও বেড়েছে। কারণ, শিশুরা দ্রুত বর্ধনশীল। ওই সময়ের পাঁচ ফুট উচ্চতার খেলোয়াড় এখন আর মাপে টিকছে না।

সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ, বয়সের বিষয়ে কঠোরতা অবলম্বন করে উচ্চতার বিষয়টি ছাড় দেওয়া হোক। এতে বেশি বয়সী খেলোয়াড় যেমন খেলতে পারবে না, তেমনি উচ্চতার কারণে কোনো শিশু বাদও পড়বে না।

পাবনার ঈশ্বরদীর পতিরাজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক মাহবুব হোসেন সরদার সমকালকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় বয়সের বাধ্যবাধকতা থাকে। তবে উচ্চতার বাধ্যবাধকতা কোথাও নেই। শুধু বাংলাদেশেই প্রাথমিকের শিশুদের ক্ষেত্রে উচ্চতাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম একলাশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খায়রুল ইসলাম মামুন বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীতে লম্বা প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। প্রাথমিকের ফুটবল খেলার ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে বয়স ও আসল খেলোয়াড় যাচাইয়ে ইউনিক আইডির তথ্য দেখা হলেই তা যথেষ্ট।

লম্বা শিশুদের খেলা থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত সমকালকে বলেন, উচ্চতার কারণে কোনো শিশু খেলা থেকে বাদ পড়তে পারে না। বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা এ নীতিমালা সংশোধনের চিন্তা করছি। তবে এ বছরের টুর্নামেন্টের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হবে না। আগামী বছর থেকে সংশোধিত নতুন নীতিমালা কার্যকর করা হবে।

আরও পড়ুন

×