ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বিশেষজ্ঞ নন, তবুও দিনে অস্ত্রোপচার গড়ে ৬টি

বিশেষজ্ঞ নন, তবুও দিনে  অস্ত্রোপচার গড়ে ৬টি

সাইদুজ্জামান উপল

তবিবুর রহমান

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২৩ | ০৮:০৫

বিশেষায়িত ডিগ্রিধারী না হয়েও নামের আগে ব্যবহার করছেন জেনারেল ও ল্যাপারোস্কপিক সার্জন পদবি। সরকারি বা বেসরকারি কোনো হাসপাতালে চাকরি না করেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক পরিচয় দেন। এই পরিচয়ে দুই বছর ধরে অবৈধভাবে দেশের বিভিন্ন জেলায় নামে-বেনামে গড়ে ওঠা ক্লিনিকে অস্ত্রোপচার করে আসছেন।

ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুও হয়েছে– এমন অনেক অভিযোগ যাঁর দিকে, তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করা সাইদুজ্জামান উপল। বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ অনুযায়ী বিডিএস বিশেষায়িত ডিগ্রিপ্রাপ্তরা ছাড়া অন্য কেউ এই পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না। কেউ করলে তাঁর চিকিৎসক নিবন্ধন স্থায়ীভাবে বাতিল হবে। তবে কোনো ধরনের বিশেষায়িত যোগ্যতা ছাড়াই সাইনবোর্ড, ভিজিটিং কার্ড এবং প্রেসক্রিপশনে বিশেষায়িত সার্জন পদবি ব্যবহার করে প্রতারণা করে আসছেন উপল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই কাজে তাঁর বেশ কয়েকজন সহযোগী রয়েছে। মূলত তাঁরাই বিভিন্ন জেলা থেকে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন– এমন রোগী সংগ্রহ করে ডা. সাইদুজ্জামানকে ফোন করেন। পরে তিনি গিয়ে অস্ত্রোপচার করে চলে আসেন। বিশেষায়িত অভিজ্ঞতা না থাকায় মাঝে মধ্যে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে।

ডা. সাইদুজ্জামানের ভুল চিকিৎসায় গত বছরের ১৫ জুলাই সাভার আশুলিয়ার বাসিন্দা মিরা খাতুন মারা গেছেন বলে অভিযোগ করেছেন তাঁর স্বামী শাহীন আলী। ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএমডিসি এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন তিনি। তবে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

শাহীন আলী বলেন, আমার স্ত্রী মিরার পেটে সমস্যা দেখা দিলে আনিছ নামের একজনের পরামর্শে পাবনা ঈশ্বরদীর সেবা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডা. সাইদুজ্জামানকে দেখানো হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি জানান, পেটে টিউমার হয়েছে; অস্ত্রোপচার করতে হবে। তবে অস্ত্রোপচার চলার সময় সাইদুজ্জামান আমাকে ডেকে বলেন, আমার স্ত্রীর ডিম্বাশয়ের দুই থলিতেই ক্যান্সার হয়েছে, বাঁচাতে হলে কেটে ফেলতে হবে। স্ত্রীর সুস্থতার নিশ্চয়তা দিলে আমি রাজি হই। তবে অস্ত্রোপচারের পর মিরার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। পরে আমি কেটে ফেলা অংশ ঢাকায় নিয়ে পরীক্ষা করালে জানতে পারি তার ক্যান্সার হয়নি, যক্ষ্মা হয়েছে। এ বিষয়ে আমি ক্লিনিক মালিক ও চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা কোনো সদুত্তর না দিয়ে আমাকে হুমকি-ধমকি দেন। এমনকি ডা. সাইদুজ্জামান আমাকে ফোন করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করলে হত্যার হুমকি দেন।

আসলেই তিনি বিশেষায়িত চিকিৎসক কিনা খোঁজ নিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনারেল সার্জারি বিভাগে যোগাযোগ করেছে সমকাল। বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ছয়েফ উদ্দিন আহমদ সমকালকে বলেন, আমাদের বিভাগে এ নামে কোনো চিকিৎসক নেই। আপনার কাছ থেকে এই নামে সার্জারি বিশেষজ্ঞ আছে, এটা প্রথম শুনলাম। এসব উড়ন্ত চিকিৎসকের মাধ্যমে ভুল চিকিৎসা বেশি হয়। এরা কোনো হাসপাতাল স্থায়ীভাবে চাকরি করেন না, যে কারণে রোগীর বিষয়ে এদের দায়বদ্ধতা থাকে না। এ ছাড়া বিএসএমএমইউর ওয়েবসাইটে এবং তাদের প্রকাশিত টেলিফোন সূচিতেও সাইদুজ্জামানের কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি।

বিএমডিসি সূত্রে জানা গেছে, ওই চিকিৎসক সার্জারি বিশেষজ্ঞ নন, এ ধরনের অস্ত্রোপচার করার প্রশিক্ষণও নেই। ডা. সাইদুজ্জামান (বিএমডিসি রেজি নং- ৭১৪৭৮) রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে ২০১৪ সালে এমবিবিএস পাস করেন। সিলেট মেডিকেল কলেজে এমএস জেনারেল সার্জারি কোর্সে ভর্তি হলেও পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তবে দুই বছর ধরে বিশেষজ্ঞ পরিচয়ে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া ও নাটোরের বিভিন্ন উপজেলায় নামে-বেনামে ক্লিনিকে চেম্বার করছেন। দিনে পাঁচ থেকে ছয়টি অস্ত্রোপচার করেন তিনি। বিএমডিসির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. লিয়াকত হোসেন সমকালকে বলেন, বিএমডিসিতে এমন অভিযোগ এলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমাতে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সরকারিভাবে একটি গাইডলাইন তৈরি করে মান অনুযায়ী ক্যাটাগরি তৈরি হচ্ছে। সারাদেশে বর্তমানে অলিগলিতে ক্লিনিক হয়ে গেছে। কিছু ক্লিনিক মানসম্মত সেবা দিলেও বেশিরভাগেরই সেবার মান ভালো না। ফিও নেওয়া হয় ইচ্ছামতো। স্ট্যান্ডার্ড ও নিয়ম অনুযায়ী যন্ত্রপাতি নেই। এসব অনিয়ম আর চলতে পারবে না।

আরও পড়ুন

×