ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

দণ্ডিত নেতাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে শঙ্কা

দণ্ডিত নেতাদের নির্বাচনে  অংশগ্রহণ নিয়ে শঙ্কা

আবু সালেহ রনি

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২৩ | ১১:২১

দুই বছর বা এর অধিক সময়ের দণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। পাশাপাশি দণ্ডিত ব্যক্তিদের আপিল উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকলেও তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না– হাইকোর্টের দেওয়া পর্যবেক্ষণসহ এ-সংক্রান্ত রায় নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। এই রায়ের ফলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ অন্তত দুই ডজন রাজনীতিবিদ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের চারজন সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্য রয়েছেন।

দণ্ডিতদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে আইনজ্ঞদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এক পক্ষ বলছে, এটি সংবিধানসম্মত। অপর পক্ষের মতে, আগামী নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে এমন পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক সমকালকে বলেন, ‘দণ্ডিতদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে বিভিন্ন সময়ে দেশের উচ্চ আদালতে ভিন্ন ভিন্ন রায় হয়েছে। তবে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মামলার রায়ে বলা হয়েছে, আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। এটাই এতদিন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা ছিল। তবে হাইকোর্টের নতুন ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় দণ্ডিতরা নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য হবেন। এর অর্থ হলো, এখন কেউ যদি দণ্ডপ্রাপ্ত হন এবং তাঁর আপিল যদি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকে, তাহলে তিনি খালাস না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। অর্থাৎ এটা যদি কার্যকর হয়, তাহলে আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই আগামী জাতীয় নির্বাচন শেষ হয়ে যাবে। ফলে আপিল করেও দণ্ডিতরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকবেন।’ তিনি আরও বলেন, হাইকোর্ট যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেটি আপিল বিভাগেই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করা বাঞ্ছনীয়।


সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সমকালকে বলেন, ‘আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। হাইকোর্টের রায়ে দণ্ডিতদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা কার্যকরের সুযোগ নেই। এ বিষয়টি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের মামলায় নিষ্পত্তি হয়েছে। ওই মামলায় আপিল বিভাগ এরশাদের আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছিল। অর্থাৎ আপিল বিচারাধীন থাকলে সেটিও বিচার ব্যবস্থা চূড়ান্ত করার আরেকটি ধাপ হিসেবে গণ্য হবে।’ তাঁর মতে, ফৌজদারি মামলায় কারও মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পর তিনি যদি আপিল করেন, তাহলে তাঁর সাজা কার্যকর স্থগিত হয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিচারে তারা সাজা বহাল না থাকে, ততক্ষণ কারা কর্তৃপক্ষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে না। এটাই আইনের স্পিরিট। তাই দুই বছরের বেশি দণ্ডপ্রাপ্তরা যদি আপিল করেন এবং সেটা যদি উচ্চ আদালতে গৃহীত হয়, তাহলে তাদেরও নির্বাচনের সুযোগ রয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তথ্যানুযায়ী, দণ্ডিত হওয়ার পর উচ্চ আদালতে আপিল বিচারাধীন এমন রাজনীতিবিদরা হলেন–বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম, কক্সবাজারের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি, বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাজাহান, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ও তাঁর ছেলে ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দিন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান ও তাঁর স্ত্রী সাবেরা আমান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, বিএনপির কোষাধ্যক্ষ রাশেদুজ্জামান মিল্লাত, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঁইয়া, ঝিনাইদহ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আবদুল ওহাব, রাজশাহী জেলা বিএনপির সভাপতি আবু সাঈদ চাঁদ, বিএনপির সহ-গ্রাম সরকারবিষয়ক সম্পাদক বেলাল আহমেদ, কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম, সাতক্ষীরার বিএনপি নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব, যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার প্রমুখ। তারা প্রত্যেকেই দুই বছরের বেশি দণ্ডপ্রাপ্ত। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে তাদের আপিল বিচারাধীন। এর মধ্যে খালেদা জিয়াসহ কয়েকজন বিএনপি নেতার সাজা হাইকোর্ট বহাল রাখার পর ওই রায়ের বিরুদ্ধে তাদের করা আবেদন আপিল বিভাগেও বিচারাধীন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বিএনপি নেতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান, ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী, শাহজাহান চৌধুরীসহ (জামায়াতে ইসলামী) কয়েকজন নেতা হাইকোর্টে খালাস পেলেও এর বিরুদ্ধে আপিল করেছে দুদক, যা এখনও বিচারাধীন।

২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর দুর্নীতির মামলায় দুই বছরের বেশি দণ্ডিত বিএনপির পাঁচ নেতার দণ্ড ও সাজা স্থগিতের আবেদন খারিজ করে সংক্ষিপ্ত রায় দেন হাইকোর্ট। পাঁচ বছর পর দুই বিচারপতির স্বাক্ষর শেষে ৪৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় গত রোববার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। আবেদনকারী বিএনপির পাঁচ নেতা হলেন– ওয়াদুদ ভূঁইয়া, মো. আবদুল ওহাব, মো. মশিউর রহমান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও আমান উল্লাহ আমান।

রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কারও দুই বছরের বেশি সাজা বা দণ্ড হলে সেই দণ্ড বা সাজার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। অবশ্য যতক্ষণ না আপিল বিভাগ ওই রায় বাতিল বা স্থগিত করে তাঁকে জামিন দেন। কারণ, কোনো আদালতের দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে আপিল বিচারাধীন থাকলেও দণ্ড বাতিল না হওয়া পর্যন্ত এই দণ্ড কার্যকর থাকে। এটা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরোপুরি বাধা। এ ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের বিধানই প্রাধান্য পাবে।

দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিতদের খালাস না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই– এমন মন্তব্য করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান সমকালকে বলেন, নৈতিক স্খলনের মামলায় দুই বছর বা তার বেশি সাজা হলে সাংবিধানিকভাবে নির্বাচনে অযোগ্য হন। সংবিধানের এ-সংক্রান্ত ৬৬(২)(ডি)-এর ব্যাখ্যা হাইকোর্ট রায়ে তুলে ধরেছেন। রায়ে বলা হয়েছে, সাজা কখনও স্থগিত হয় না। আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দণ্ড বহাল থাকবে।

সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি (ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।’

অতীতে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ, সরকারদলীয় সাবেক মন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ বিভিন্ন ব্যক্তি দুই বছরের বেশি দণ্ডের বিরুদ্ধে করা আপিল উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় সংসদ সদস্যপদে দায়িত্ব পালন করেছেন– এমন প্রশ্নে খুরশীদ আলম খান বলেন, তখন বিষয়টি নিয়ে কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি বা হাইকোর্ট থেকে কোনো রায় পাওয়া যায়নি। এবার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। তবে এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল তাঁর এক রায়ে বলেছেন, আপিল হলো বিচারের চলমান প্রক্রিয়া। কোনো দণ্ডই চূড়ান্ত হবে না, যতক্ষণ না আপিল বিভাগ চূড়ান্ত করে। তাই আপিলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দণ্ড কার্যকর না হওয়ার কারণে দণ্ডিতদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা থাকার কথা নয়। এ ব্যাপারে আপিল বিভাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।


আরও পড়ুন

×