ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন

ফ্রিজ-এসির ক্ষতিকর গ্যাসের ব্যবহার বন্ধ না হলে দ্বিগুণ হবে জলবায়ুর ক্ষতি

বাংলাদেশ পক্ষে থাকলেও এখনও সন্মতি দেয়নি

ফ্রিজ-এসির ক্ষতিকর গ্যাসের ব্যবহার বন্ধ না হলে দ্বিগুণ হবে জলবায়ুর ক্ষতি

ছবি: সমকাল

আবু সালেহ রনি, দুবাই থেকে

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১১:২৮ | আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১৫:২১

বৈশ্বিক উষ্ণতায় পুড়ছে পুরো পৃথিবী। বহু বছর ধরেই জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে মেরু অঞ্চলে বরফ গলা ও সাগরের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

চলতি বছর ইউরোপিয়ান এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির (ইইএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চরম আবহাওয়া পরিস্থিতিতে ইউরোপে গত ৪০ বছরে মারা গেছেন প্রায় ১ লাখ ৯৫ হাজার মানুষ। শুধু প্রাণহানিই নয়, এ কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৫৬০ বিলিয়ন ইউরোর বেশি। ক্ষতির তালিকায় আছে বাংলাদেশও।

গতকাল মঙ্গলবার বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে ‘গ্লোবাল কুলিং’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত এবারের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ ২৮)। সম্মেলনের ৬ষ্ঠ দিনে অন্তত ৬০টি দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে গ্লোবাল কুলিং, অঙ্গীকার স্বাক্ষরের বিষয়ে সম্মত হয়। তবে বাংলাদেশ এখনো এ বিষয়ে সম্মতি দেয়নি।

জানতে চাইলে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্লেষক আইনুন নিশাত সমকালকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে যে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, তার জন্য  মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী। এসি-ফ্রিজে ব্যবহৃত গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে। এসব কারণে তাপপ্রবাহ অন্তত ৩০ গুণ বেড়েছে। অর্থাৎ, এসি-ফ্রিজে ব্যবহৃত গ্যাস, কল-কারখানার ধোঁয়া, বনাঞ্চল উজাড়সহ মানবসৃষ্ট দূষণ না হলে এমনটি হতো না।

পরে গ্লোবাল কুলিং অঙ্গীকারের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জানতে চাইলে সম্মেলনে উপস্থিত পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক জিয়াউল হক সমকালকে বলেন, ফ্রিজ-এসিসহ ঠান্ডা তৈরি করে এমন জিনিসপত্রে দুই ধরনের গ্যাস অথাৎ এইচএফসি ও এইচসিএফ গ্যাস ব্যবহার হয়। এগুলোর কারণে পৃথিবীর ওজন স্তর ফুটো হয়ে যাচ্ছে। এজন্য জলবায়ু সম্মেলনে ৬০টি দেশ এই দুটি গ্যাসের ব্যবহার বন্ধ করে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারে ঐক্যমত হয়েছে। বাংলাদেশ এ বিষয়ে এখনও সম্মতি না দিলেও এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

গতকাল সম্মেলনে কপ প্রেসিডেন্সির মূল আলোচনায় ৫টি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। যার মধ্যে জ্বালানি পরিবর্তন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আদিবাসীদের ভূমিকা, সমন্বিত একটি গ্লোবাল কুলিং প্লেজ ইভেন্ট, জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি এবং সবচেয়ে দুর্বলদের জন্য টেকসই শীতলকরণে অ্যাক্সেস বাড়ানোর পদক্ষেপ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও সম্মেলনের সাইড ইভেন্টে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের আলোচনায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নারী-শিশুর স্বাস্থ্যগত প্রভাব ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সভা অনুষ্ঠিত হয়।

গ্লোবাল কুলিং নিয়ে সম্মেলনের আলোচনায় বলা হয়, কুলিং ইকুইপমেন্টের বিদ্যুত খরচ কমানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।  এটি গ্রহণ করলে ২০৫০ সালের পূর্বাভাসিত সেক্টরাল নির্গমন কমপক্ষে ৬০ শতাংশ হ্রাস পাবে, জীবন রক্ষাকারী শীতলতায় সর্বজনীন অ্যাক্সেস প্রদান করবে, এসব পদক্ষেপের ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে ট্রিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে। যদি গ্লোবাল কুলিং নিয়ন্ত্রণ করা না হয় তাহলে বর্তমানে জলবায়ু যে ক্ষতি হচ্ছে তা একই সময়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে, অথাৎ ব্যবহারের পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ দ্বিগুণ হবে।

আলোচনার সময় প্রকাশিত নতুন প্রতিবেদনে গ্লোবাল কুলিং ওয়াচ রিপোর্ট, কিপিং ইট চিল: নিঃসরণ কমানোর সময় শীতল করার চাহিদা কীভাবে পূরণ করা যায় তা তুলে ধরা হয়েছে। সভায় শুভেচ্ছা দূত এলি গোল্ডিংয়ে নেতৃত্ব দেন।

জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষতি: পরিবেশ দূষণ রোধে জলবায়ু সম্মেলনের সাইড লাইনে সিএসও হাবে এক আলোচনা সভায় গতকাল ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প ব্যবহারের দাবি উঠেছে।

সভায় বক্তব্য রাখেন এশিয়ান পিপলস মুভমেন্ট অন ডিবেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের লিডি নেকপিল, ফিলিপাইন মুভমেন্ট ফর জাস্টিসের আন রিভেরা, ইন্দোনেশিয়ার ট্রেন্ডএশিয়ার বিয়েরা ট্রাসডিয়ান, ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের শরীফ জামিল, পাকিস্তানের ইন্দ্রোস কনসোটিয়ামের ড. মাজিদ বিলাল, পাকিস্তান কিষান রাবিতা কমিটির জাইমা আব্বাস, থাইল্যান্ডের ক্লাইমেট ওয়াচের ওনুন প্রিমপাবুল।

সভায় ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের শরীফ জামিল বলেন, জ্বালানি একটি কৌশলগত পণ্য। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ গুলোর মধ্যে ৭০ শতাংশ দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানি।  টেকসই নবায়নযোগ্য জ্বালানি অভাবে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতার ফলে বর্তমানে জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে। জ্বালানি নিরাপত্তায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকল্প নেই। তবে এটাও খেয়াল রাখতে হবে জ্বালানি নিরাপত্তা দিতে গিয়ে যেন পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

শ্রমিকদের জীবিকা নিরাপত্তা সমন্বিতভাবে নিশ্চিতের দাবি: জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের মধ্যে উৎকন্ঠা রয়েছে। এগুলো বিবেচনার জন্য নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে পরিবেশ নিয়ে কর্মরত বাংলাদেশের দুটি নাগরিক সংগঠন। আলোচকরা সবুজ প্রযুক্তি প্রসার পরিকল্পনায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের জীবিকা নিরাপত্তা সমন্বিতভাবে বিবেচনার দাবি জানান।

জলবায়ু সম্মেলনের বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন এবং ঐশি ফাউন্ডেশন আয়োজিত সভায় বক্তব্য রাখেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ, আইএলওর সামাজিক সুরক্ষা বিভাগের প্রধান জানা বিসলার, এফিয়েস জামার্নীর ক্লাইমেট পলিসি অ্যাডভাইজার ড. ফ্র্যানজিসকা, কানাডার ট্রেড ইউনিয়নিফরের প্রতিনিধি মিস সারি সাইরামেন। ঐশি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারপার্সন ড. এস এম মোর্শেদের সঞ্চালনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক আমিনুর রশিদ চৌধুরী। এতে বলা হয়, পরিবেশ সুরক্ষার স্বার্থে বাংলাদেশে চামরা শিল্পে হাজারিবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের কারণে চার হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছে। অন্যদিকে চামরা শিল্প নগরীতে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই পরিবেশ কমপ্লায়ন্স নিশ্চিত করতে পারেনি। তাই সবুজ প্রযুক্তি প্রসার পরিকল্পনায় শ্রমিকের জীবিকা নিরাপত্তা সমন্বিতভাবে বিবেচনার দাবি জানানো হয়।

এদিকে বিশ্ব ব্যাংকের উদ্যোগে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে সম্মেলনের সাইড লাইনে সভা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্যান্য উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা অংশ নেন।

সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুরোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। ডেঙ্গুরোগসহ অন্যান্য ভেক্টর-বর্ণ ডিজিজসমূহ বৃদ্ধির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনই দায়ী। এই জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তারে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো দায় এড়াতে পারে না। এ কারনে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতি কমিয়ে নিতে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোকে সহযোগিতার হাত আরো প্রসারিত করতে হবে, পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে সহোযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে।’

আরও পড়ুন

×