ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বিএনপির ‘অসহযোগ’ আন্দোলন

লক্ষ্য অর্জনে ‘শান্তিপূর্ণ’ কর্মসূচির সিদ্ধান্ত

লক্ষ্য অর্জনে ‘শান্তিপূর্ণ’ কর্মসূচির সিদ্ধান্ত

.

 লোটন একরাম

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০১:১৫ | আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৯:১০

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ‘প্রতিহত’ করার পরিবর্তে ‘শান্তিপূর্ণ’ কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণকে ভোট বর্জনে ‘উদ্বুদ্ধ’ করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবেই নির্বাচনকে ‘একতরফা’ আখ্যায়িত করে মূলত ‘অসহযোগ’ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। লক্ষ্য অর্জনে দেশব্যাপী ব্যাপক গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করবে তারা। থাকবে রাজপথে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি। ভোটের আগে ‘গণকারফিউ’ দেওয়ার চিন্তাও রয়েছে। গণতন্ত্রের স্বার্থে জনগণ স্ব-স্ব অবস্থান থেকে যথাযথ ‘ভূমিকা’ রাখবে বলে আশা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের। অবশ্য দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের কর্মসূচিতে জনগণ কতটা উদ্বুদ্ধ হবে– তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অবশ্য বিএনপি বলছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের চলমান আন্দোলনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে সুনির্দিষ্ট নানা পরিকল্পনা রয়েছে। আন্দোলনে তারা ক্রমান্বয়ে জনগণের উপস্থিতি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। জনগণ সাড়া দিচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপির এ আন্দোলনকে পাত্তা দিচ্ছে না তারা। তবে রাজনীতি নিয়ে জনগণের মধ্যে বিভক্তি থাকায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন কঠিন হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

কর্মসূচি নিয়ে দ্বিমত রয়েছে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণতন্ত্র মঞ্চ এবং সমমনা দলগুলোর মধ্যেও। সমন্বয়হীনতা থাকলেও আন্দোলনের প্রধান দলের দেওয়া কর্মসূচির প্রতি ‘নৈতিক সমর্থন’ দিয়েছে সমমনারা। পাশাপাশি যুগপৎ কর্মসূচির অংশ হিসেবে অবরোধ ও গণসংযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলগুলো। তবে নেতাকর্মীর আদালতে হাজিরা না দেওয়া কিংবা সরকারকে সব রকম ট্যাক্স, খাজনা, ইউটিলিটি বিল এবং অন্যান্য প্রদেয় স্থগিত করার যে নির্দেশনা দিয়েছে, তাতে বিএনপি ও সমমনা দলের ভেতরেই অনেকে বিস্মিত। হঠাৎ সরাসরি অসহযোগের মতো কর্মসূচি ঘোষণা অসময়ে হয়ে গেছে কিনা, তা নিয়ে বিএনপিসহ সমমনা দলের ভেতরে-বাইরে হচ্ছে নানা আলোচনা। তবে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি নন। দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার মতে, সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি সমমনা ও দলীয় ফোরামে  আলোচনা করেই চূড়ান্ত করা হয়। তবে অসহযোগ কর্মসূচির ক্ষেত্রে সেটি হয়নি বলে দাবি করছেন কোনো কোনো নেতা।   

বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মতে, বাস্তবতার আলোকে বর্তমান পরিস্থিতিতে কর, খাজনা, ইউটিলিটি বিল প্রদান বন্ধ, আদালতে মামলার হাজিরা না দেওয়া, ব্যাংকে টাকা না রাখার আহ্বান বাস্তবায়ন করা হয়তো কঠিন। ‘প্রতীকী’ অর্থেই সরকারকে নানাভাবে ‘অসহযোগিতা’ করার পরিকল্পনা থেকেই এ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের ওপর যেমন চাপ তৈরি হবে, তেমনি জনগণও যার যার অবস্থান থেকে ‘ভূমিকা’ রাখতে চেষ্টা করবে। মানুষ সচেতন হলে অনেকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগিতামূলক ‘ভূমিকা’ রাখতে পারবে বলে মনে করেন তারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান গতকাল সমকালকে বলেছেন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বিএনপির চলমান আন্দোলনে অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণা নতুন করে প্রমাণ করে, তারা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির প্রতি আস্থাশীল। বিএনপি একটি উদারপন্থি রাজনৈতিক দল, যারা ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দাবি আদায়ে আন্দোলনের কর্মসূচি পরিচালনা করে থাকে। অসহযোগ আন্দোলন দেশের ১৮ কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁর বিশ্বাস। 

জানা গেছে, অতীতে ১৯৭১ সালের ‘অসহযোগ’ কর্মসূচির মতো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট না হলেও ১৯৯৬ সালের পরিস্থিতি অনুসরণ করে এ কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। ২৭ বছর আগে বিএনপি সরকারের আমলে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জামায়াত ও জাতীয় পার্টি ‘অসহযোগ’ আন্দোলন করেছে। 

বিএনপির বিরুদ্ধে ’৯৬ সালে অসহযোগের মধ্যেই হরতাল, ঘেরাও ও অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বিএনপিও অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণার পাশাপাশি গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে টানা তিন দিন গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ এবং রোববার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ভোটের আগে গণকারফিউর মতো কর্মসূচির কথা ভাবছে বিএনপি। কর্মসূচির প্রথম দিন গতকাল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লিফলেট বিতরণ করেছে দলটি। লিফলেটে আন্দোলনের পক্ষে নানা যুক্তি ও বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। 

বিএনপি নেতা জানান, আওয়ামী লীগ আবারও ২০১৪ ও ’১৮ সালের মতো একতরফা আরেকটি নির্বাচনের সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে বাইরে রেখে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। মিত্র ও জোটের শরিকদের আসন ভাগাভাগি করে শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীদের নাম ঘোষণার বাকি রয়েছে। এখন ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নেওয়াই আওয়ামী লীগের বড় চ্যালেঞ্জ।

শেখ হাসিনা সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলে বুধবার জানিয়েছে বিএনপি। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে জনগণকে ভোট দিতে না যাওয়া, কর ও সেবার বিল জমা না দেওয়া এবং প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের প্রতি ভোট বর্জনের আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে বিএনপির যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তাদেরও আদালতে হাজিরা না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে গণসংযোগ, লিফলেট বিতরণ ও অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। 

এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল সমকালকে বলেন, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে ইতোমধ্যে গণসংযোগ শুরু করা হয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে, এ আন্দোলন যাতে নামসর্বস্ব হয়ে না পড়ে। সময়ই বলে দেবে, কী হবে? এ ছাড়া লিফলেট বিতরণ করা হবে। এতে বিএনপির আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে বিস্তারিত বর্ণনা থাকবে বলে জানান তিনি। 

একই সঙ্গে বিএনপির এ মুখপাত্র বলেন, তারা তাদের আন্দোলনের বিষয়বস্তু বিভিন্ন সময় জনগণের কাছে তুলে ধরেছেন; সাড়াও পেয়েছেন। এতে প্রমাণ হয়, তাদের কর্মসূচিতে জনগণের সমর্থন আছে। তিনি বলেন, প্রযুক্তিনির্ভর গণমাধ্যম (সামাজিক গণমাধ্যম) ব্যবহার করেও মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হবে।

দলীয় সূত্র জানায়, রাজপথের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি, গণসংযোগ, লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি ভোট বর্জনে ‘জনমত’ তৈরি করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কাজে লাগাবে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। ডিজিটাল প্রচারে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন ডকুমেন্টারি। এতে ‘একতরফা’ নির্বাচনে জনগণের ক্ষমতায়নে নেতিবাচক প্রভাব, ভোটাধিকার হরণ, আন্তর্জাতিক বিশ্বে নেতিবাচক সম্পর্ক তৈরির আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে এই ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনের প্রভাবে দেশের শিল্প-বাণিজ্যে ‘পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা’র শঙ্কা রয়েছে বলেও সতর্ক করা হচ্ছে জনগণকে। সামাজিক মাধ্যমে প্রচারে বিরোধী দলের নেতাকর্মীর ওপর নির্যাতনের চিত্র, মামলা-হামলা আর আদালতে ‘ফরমায়েশি’ সাজা দেওয়ার ঘটনাও থাকবে। 

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সমকালকে বলেন, অসহযোগ আন্দোলনের যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, তা শান্তিপূর্ণভাবেই বাস্তবায়ন করতে চান তারা। সমাজের সচেতন মানুষ তার ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। গণতন্ত্র মঞ্চ অসহযোগ আন্দোলনকে রাজনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। সারাদেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কাছে ভোট বর্জনের বার্তা পৌঁছে দিতে চান তারা, যাতে মানুষ স্ব-স্ব অবস্থান থেকে ফ্যাসিবাদী সরকারের একতরফা ও তামাশার ভোট বর্জন করে দাবি আদায়ে সহায়তা করে। তারা মানুষের চিন্তা-বুদ্ধি ও বিবেকের ওপর ছেড়ে দিতে চান।

এলডিপির সদস্য সচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম সমকালকে বলেন, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার রক্ষায় দেশের মানুষকে ‘সচেতন’ করে ভোটদান থেকে বিরত রেখে নির্বাচন ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ করতেই মূলত অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। মানুষ ইচ্ছা করলে সরকারকে নানাভাবে অসহযোগিতা করতে পারে। যেমন প্রবাসীরা ইচ্ছা করলে রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দিতে পারেন।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশের পর থেকে দু-এক দিনের বিরতিতে টানা অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি পালন করে আসছে। তারা বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা দলটির হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিতে বর্তমানে অনেকটাই ঢিলেঢালা ভাব চলে এসেছে। বিশেষ করে মধ্য নভেম্বরের পর থেকেই ঢাকা ও ঢাকার বাইরে হরতাল-অবরোধের প্রভাব কমে আসতে থাকে। 

 

আরও পড়ুন

×