ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

আগুন লেগেছে বলে কথা শেষ করতে পারেননি এলিনা

আগুন লেগেছে বলে কথা শেষ করতে পারেননি এলিনা

এলিনা ইয়াসমীন

আব্দুল হামিদ

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ | ০১:৩৬ | আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ | ০৮:৩০

‘ট্রেনে আগুন লাগছে, তুমি আমারে...’ স্বামীর সঙ্গে সর্বশেষ কথোপকথনে এটুকুই বলতে পেরেছিলেন এলিনা ইয়াসমীন। এর পর থেকেই তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। বাক্যটি শেষ করতে না পারায় তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন, তা স্পষ্ট হয়নি। আর কোনো দিন তা জানা যাবে কিনা, সেটিও অনিশ্চিত। এ কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিখোঁজ এলিনার স্বামী সাজ্জাদ হোসেন চপল। তিনি বলেন, চারপাশে আগুন দেখে হয়তো বাঁচানোর অনুরোধই করতে চেয়েছিল, কিন্তু কথাটি শেষ করতে পারেনি।

গত শুক্রবার রাতে ছয় মাসের ছেলে আরফান হোসেনকে নিয়ে রাজবাড়ী থেকে বেনাপোল এক্সপ্রেসে ঢাকায় ফিরছিলেন এলিনা। রাজধানীর গোপীবাগে ট্রেনে আগুন লাগার পর তিনি স্বামীকে কল করেন। এর পর থেকে তাঁর খোঁজ মিলছে না।

সাজ্জাদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, এলিনা বেনাপোল এক্সপ্রেসের ‘চ’ বগিতে ৫১ থেকে ৫৪ নম্বর এই চারটি সিটের একটিতে ছিল। ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের পর ৯টা ১০ মিনিটে আমাকে ফোন দেয়। এ সময় আশপাশে অনেক মানুষের কান্নাকাটি আর চিৎকার-চেঁচামেচি শোনা যায়। এর মধ্যে এলিনা কই হারালো জানি না।
তিনি জানান, এলিনার নিখোঁজের খবর এখনও তাঁর মা হোসনে আরাকে জানানো হয়নি। এলিনা রাজবাড়ী শহরের লক্ষ্মীকোল গ্রামের মৃত সাইদুর রহমান বাবুর মেয়ে। সাজ্জাদ রাজধানীর মিরপুরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন। গত ২৭ ডিসেম্বর এলিনার বাবার মৃত্যু হয়। সে সময় তারা রাজবাড়ীতে যান। পরে অফিসের কাজে ওদের রেখেই ঢাকায় চলে আসনে সাজ্জাদ। সর্বশেষ শুক্রবার মামাতো বোনের সঙ্গে এলিনা ঢাকায় ফিরছিলেন। ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডে সবাই নামতে পারলেও এলিনার খোঁজ নেই।
গত শুক্রবার রাত ৯টার দিকে রাজধানীর গোপীবাগ এলাকায় বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লাগে। এতে ঘটনাস্থল থেকে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনায় আহত হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছেন ১০ জন। এ ছাড়া উদ্ধার মরদেহ শনাক্ত করতে না পারায় পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। আজ সোমবার মরদেহ দাবি করা পরিবারের ডিএনএ সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

এদিকে খোঁজ মিলছে না রাজবাড়ীর আরও দু’জনের। তারা হলেন– রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের চিত্তরঞ্জন চৌধুরীর মেয়ে চন্দ্রিমা চৌধুরী সৌমি ও কালুখালীর মৃগী ইউনিয়নের শিকজান গ্রামের হক মণ্ডলের ছেলে মো. তাসলামের।
গতকাল রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, দুপুরে লক্ষ্মীকোল গ্রামে নিখোঁজ এলিনাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, স্বজনরা পাশাপাশি বসেও কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছেন না। কারও চোখে পানি। সুনসান নীরবতা। এ সময় এলিনার মামাতো ভাই গাজী পলাশ জানান, গত ২৭ ডিসেম্বর এলিনার বাবা মারা যান। সে কারণেই ঢাকা থেকে বাবার বাড়ি আসেন তিনি। পরে শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজবাড়ী স্টেশন থেকে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে তুলে দিয়ে আসি। তার সঙ্গে ফুফাতো বোন ডেইজি আক্তার, তাঁর স্বামী ইকবাল বাহার খান, দুই ছেলে মো. দিহান ও মো. রেহান ছিল।
তিনি জানান, ফুফু স্বামীর মৃত্যুর শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এরই মধ্যে এলিনা নিখোঁজ। তার নিখোঁজের খবর দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, এলিনা হাসপাতালে ভর্তি।

পুড়ে অঙ্গার বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেন
অগ্নিকাণ্ডে অঙ্গার হওয়া ট্রেনটি রাখা হয়েছে কমলাপুর রেলস্টেশনে। গতকাল ট্রেনটি সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ট্রেনের পাওয়ার কার ‘ঙ’ বগির বেশির ভাগ অংশ পুড়ে গেছে। আর ‘চ’ ও ‘ছ’ যাত্রীবাহী দুটি বগি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ট্রেন থেকে এখনও ভ্যাপসা গন্ধ ছড়াচ্ছে। ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, ট্রেনটি যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাচ্চাদের ফিডার, হাতের বালা ও চুড়ি, দুধের কৌটা ও বইয়ের পোড়া অংশ।

ট্রেনটির নিরাপত্তায় পাঁচ পুলিশ সদস্য ও দু’জন আনসার সদস্য ছিলেন। ‘চ’ বগির দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সুস্থ আছেন বলে জানান। পরে ঘটনা জানতে চাইলে বলেন, ট্রেনের মধ্যে আছি, কোনো কথা বোঝা যাচ্ছে না। পরে কথা হবে।
‘ছ’ বগির দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য মামুন বিল্লাহ সমকালকে বলেন, সায়েদাবাদ রেলক্রসিং পার হওয়ার পর ট্রেনের যাত্রীরা নামার জন্য দরজার কাছে চলে আসে। এ সময় ট্রেনের মধ্যে অনেকটা ফাঁকা হয়ে যায়। আমি ‘ছ’ বগির দরজায় ছিলাম। হঠাৎ দেখি ধোঁয়া আর যাত্রীরা আগুন আগুন বলে চিৎকার করছে। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের চেইনে টান দিই। ট্রেন দাঁড়িয়ে গেলে যাত্রীদের নামিয়ে আনতে সহায়তা করি। তবে ধারণা করছি, ট্রেনের ‘চ’ বগির মাঝখানে কে বা কারা আগুন দেয়।

ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা ও তদন্ত
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পরিচালক নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে তিন থেকে চারজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি মামলা করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস। এর আগে বিএনপি নেতা জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক নবী উল্লাহ নবীসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। ডিবির দাবি, এ ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীরা জড়িত। নবী এ ঘটনার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতা। এ ছাড়া ভিডিও কনফারেন্সে যুবদল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক খন্দকার এনামুল হক এনাম ও সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় এই নাশকতা ঘটানো হয়।

আরও পড়ুন

×