ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

উচ্চ আদালতে এখনও ইংরেজির প্রাধান্য

উচ্চ আদালতে এখনও ইংরেজির প্রাধান্য

.

 আবু সালেহ রনি

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০০:৩০ | আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৮:২০

বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থাকলেও উচ্চ আদালতে তা যথাযথভাবে প্রতিপালন হচ্ছে না। মামলার নথিতে বর্ণনা, সারসংক্ষেপ থেকে শুরু করে আদালতে শুনানি– সবই ব্রিটিশ আমলের ধারাবাহিকতায় হচ্ছে ইংরেজিতে। রায় ও আদেশ ঘোষণার পাশাপাশি তা লেখাও হয় ইংরেজিতে। বিচারক ও আইনজীবীরা ইংরেজিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন সর্বত্র। অথচ দেশের অধস্তন আদালতে শুনানির পাশাপাশি রায় ও আদেশ প্রদানসহ যাবতীয় কাজ বাংলাতেই হচ্ছে।

উচ্চ আদালতে এখন বিচারপতি ৯৪ জন। ব্যতিক্রম হিসেবে তাদের মধ্যে দু’জন সারাবছরই বাংলায় রায় ও আদেশ দিচ্ছেন। আরও ১১ বিচারপতি বিভিন্ন সময়ে বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন। তবে এই সংখ্যা প্রতিবছরই কমছে।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে উচ্চ আদালতের রায় ও আদেশ অনুবাদের জন্য ‘আমার ভাষা’ নামে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি সফটওয়্যার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে চালু হলেও এর কার্যক্রম অনেকটা গতিহীন। ওই ওয়েবসাইটে রায় ও আদেশ গুগলে অনুবাদের ব্যবস্থা রাখা হলেও বিচারপ্রার্থীদের জন্য তা যথাযথ নয়। এ ছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা ও শিক্ষার স্তর ভালো না হওয়ায় অধিকাংশ বিচারপ্রার্থীকে আইনজীবীর মাধ্যমে রায় ও আদেশের ভাবার্থ বুঝতে হচ্ছে। ফলে উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহার না হওয়ায় সামগ্রিকভাবে বিচারপ্রার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম সমকালকে বলেন, ‘বাংলা ভাষায় রায় দিতে অনেক প্রস্তুতি নিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজি একটি শব্দের তিন-চারটি বাংলা অর্থ হয়। রায়ের ক্ষেত্রে কোনটি প্রযোজ্য, তা ভালো করে জেনে প্রয়োগ করতে হয়। তা না হলে রায়ের অর্থ বিকৃত হয়ে যাবে এবং তাতে জটিলতা আরও বাড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে দুইজন বিচারপতি নিয়মিত বাংলায় রায় দিচ্ছেন, তারা সহায়ক কর্মকর্তাসহ সামগ্রিক কাঠামো সেভাবে তৈরি করে নিয়েছেন। তাই তাদের সমস্যা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে অন্য বিচারকরা একই পদ্ধতি অবলম্বন করলে বাংলায় রায় দেওয়ার সংখ্যা বাড়তে পারে।’

আইনি প্রেক্ষাপট
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর কার্যকর হওয়া বাংলাদেশ সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে একমাত্র বাংলার কথা উল্লেখ করা হয়। পরে ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে এক জনসভায় উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় দেওয়ার পাশাপাশি দাপ্তরিক কার্যক্রমেও এর ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ বাংলা ভাষা প্রচলন-সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশনার প্রজ্ঞাপন জারি হয়। কিন্তু বাস্তবে সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার সংকুচিত হতে থাকে। এমন প্রেক্ষাপটে ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রবর্তন করে সরবকার।

ওই আইনের (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন প্রবর্তনের পর দেশের সর্বত্র, তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’ এরই ধারাবাহিকতায় নব্বই দশকে উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহারের বিষয়ে আলোচনা জোরদার হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক বছর ধরে উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহারের বিষয়ে তাগিদ দিচ্ছেন। ২০২১ সালে ইংরেজি সাড়ে চার হাজার শব্দের বাংলা পরিভাষাসহ প্রায় সাড়ে ১০ হাজার শব্দের ‘আইন শব্দকোষ’ প্রকাশ করে আইন কমিশন। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনও রায় অনুবাদের জন্য ‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যার চালু করে। এত কিছুর পরও উচ্চ আদালতে ইংরেজির প্রাধান্য। তবে দাপ্তরিক অনেক কাজ এখন বাংলায় হয়।

ব্যতিক্রম দুই বিচারপতি
উচ্চ আদালতে বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ দিচ্ছেন। বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল এই পদে যোগদানের পর কখনোই ইংরেজিতে রায় ও আদেশ লেখেননি। তাঁর বাংলায় রায় ও আদেশ এরই মধ্যে ২০ হাজার ছাড়িয়েছে, যা বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন। অন্যদিকে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট থেকে বাংলায় রায় ও আদেশ লিখছেন, যার সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। এ ছাড়া গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বাংলায় আদেশ দিচ্ছেন। আদালত সূত্রে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্টে এখন আইনজীবীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। তাদের ছয় থেকে আটজন নিয়মিত বাংলায় মামলা দায়ের ও শুনানি করেন।

আদালতে বাংলা ব্যবহারের প্রেক্ষাপট
প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী দেশ স্বাধীনের পর নব্বই দশকে বাংলায় কয়েকটি আদেশ ও রায় দেন; কিন্তু তা আইন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত আইন সাময়িকীর (ঢাকা ল রিপোর্টস ৫০ ও ৫১ ডিএলআর) তথ্য অনুসারে, ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও বিচারপতি হামিদুল হক সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নজরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র মামলার রায় দেন বাংলায়। একই সময়ে বিচারপতি হামিদুল হক অন্য একটি ফৌজদারি রিভিশন মামলায় বাংলায় রায় দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় সাবেক বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ, প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ বাংলায় রায় দেন।

বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি সমকালকে বলেন, ‘ইংরেজির বাংলা প্রতিশব্দ না থাকায় অনেক বিচারপতি আগ্রহ থাকলেও বাংলায় রায় বা আদেশ দিতেন না। বিষয়টি উপলব্ধি করে আইন কমিশন থেকে আইন শব্দকোষ প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে ১০ হাজারের বেশি পরিভাষা সন্নিবেশ হয়েছে। এখন সদিচ্ছা থাকলে সব বিচারপতিই বাংলায় রায় ও আদেশ দিতে পারেন।’
 
ভাষার মাসে অনন্য উদ্যোগ
ভাষার মাস উপলক্ষে গত কয়েক বছর ধরেই উচ্চ আদালতে বিচারপতিদের মধ্যে বাংলা ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। চলতি মাসেই বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ এবং বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন। তারা এখন পর্যন্ত ১৫টি মামলায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন বাংলায়।

রায় অনুবাদে ‘আমার ভাষা’
সাধারণ মানুষ ও বিচারপ্রার্থীদের সুবিধার্থে ২০২১ সালে উচ্চ আদালতের রায় বাংলায় অনুবাদ করতে 
‘আমার ভাষা’ নামে একটি সফটওয়্যার চালু করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এই সফটওয়্যারে তিন বছরে ৩৪টি রায় বাংলায় অনুবাদ করে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। যদিও উচ্চ আদালতে প্রতি বছর গড়ে ৮০ হাজার মামলা নিষ্পত্তি হয়।
এ বিষয়ে আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার (জেলা জজ) মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ কিছু রায় বা আদেশ জনস্বার্থে অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়েছে। আরও কিছু রায় অনুবাদ হয়ে আছে। শিগগির তা প্রকাশ করা হবে।’

 

আরও পড়ুন

×