সড়ক আইনে কমছে শাস্তি ও জরিমানা

.
সাব্বির নেওয়াজ
প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৪ | ২৩:৫৫ | আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৪ | ০৮:২৯
চালক ও পরিবহন শ্রমিকদের শাস্তি কমিয়ে সংশোধন করা হচ্ছে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থদণ্ডও কমানো হচ্ছে। আইনটি সংশোধনের খসড়া অনুমোদনের জন্য আজ বুধবার উঠছে মন্ত্রিসভার বৈঠকে।
খসড়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাস থেকে কমিয়ে পঞ্চম শ্রেণি করা হচ্ছে।
এর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর সারাদেশের স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামে। তারা সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানায়। অনেক বিশেষজ্ঞ সড়ক দুর্ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ আখ্যায়িত করেন। এর পর সরকার সড়ক পরিবহন আইন কিছুটা কঠোর করে। সেই আইন সংশোধন ও শাস্তি কমিয়ে এখন ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০২৪’ করা হচ্ছে।
এই আইনের ৪৯ ধারায় প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ‘মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোনো চালক মোটরযান চালাতে পারবে না। মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোনো কন্ডাক্টর বা মোটরযান শ্রমিক মোটরযানে অবস্থান করতে পারবে না। মোটরযান চালক কোনো অবস্থাতে কন্ডাক্টর বা মোটরযান শ্রমিককে মোটরযান চালনার দায়িত্ব প্রদান করতে পারবে না।’
সড়ক দুর্ঘটনায় অভিযুক্ত চালক ও পরিবহন শ্রমিকদের জেল-জরিমানায় বড় ছাড় দিয়ে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০২৪’ সংশোধন করতে যাচ্ছে সরকার। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতর আহত হলে বা প্রাণহানি ঘটলে, দায়ী ব্যক্তির সর্বোচ্চ পাঁচ বছর জেল বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাবে ‘গুরুতরভাবে আহত’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জরিমানা ৫ লাখ থেকে কমিয়ে ৩ লাখ টাকা করা হচ্ছে। এভাবে আইনের প্রায় ১০ জায়গায় শাস্তি কমানোর প্রস্তাব সংশোধনীতে করা হয়েছে।
সংশোধনীর খসড়ায় তিন চাকার মোটরযানের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রস্তাব করা হয়েছে ‘পঞ্চম শ্রেণি পাস’। বিদ্যমান আইনে এ যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি। এমনকি যন্ত্রচালিত বা বৈদ্যুতিক ব্যাটারিচালিত যানবাহন, বাইসাইকেল, রিকশা ও রিকশাভ্যানকে মোটরযানের স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বীমার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে সংশোধনীতে। খসড়াটি যাচাই-বাছাই করে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় পাঠিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। আজ বুধবার তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ওই বৈঠক হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবহন খাতে যাদের শৃঙ্খলায় আনতে আইনটি তৈরি, তাদের চাপে এখন সংশোধন করা হলে আইনের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। যে উদ্দেশ্যে আইনটি করা হয়েছিল, তাও ভেস্তে যাবে।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘চালক ও শ্রমিকদের শাস্তি কমিয়ে আইনটি সংশোধন করা হলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। সরকার পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই সংশোধনী পাস হলে পরিবহন খাতে সরকারের অসহায়ত্ব বাড়বে।’ সড়ক পরিবহন আইনে শাস্তি কমানোর মধ্য দিয়ে জনগণের স্বার্থ চরমভাবে বিকিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
তবে এসব বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী কিছু বলতে রাজি হননি।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ পাস হয়। গেজেট জারি হয় ৮ অক্টোবর। তখন আইনে বলা হয়, সরকার আইনটি কার্যকরের তারিখ ঠিক করে এর প্রজ্ঞাপন জারি করবে। এই সুযোগে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো আইন পরিবর্তনের দাবিতে দুই দফা ধর্মঘট করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও রেলমন্ত্রীর সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
ওই বছরের নভেম্বরে সরকার আইনটি প্রয়োগ করার ব্যবস্থা নিলে পরিবহন সংগঠনগুলো এর বিভিন্ন ধারা পরিবর্তনের দাবিতে আবারও ধর্মঘট ডাকে। তাদের মূল দাবি ছিল, আইনের অধীনে সব অপরাধ জামিনযোগ্য করতে হবে। জরিমানাও কমাতে হবে।
ওই ঘটনার চার বছরের মাথায় আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। বিদ্যমান আইনের ৮৪, ৯৮ ও ১০৫ ধারায় বর্ণিত অপরাধ জামিন অযোগ্য। কিন্তু সংশোধনীতে, ৮৪ ও ৯৮ ধারার অপরাধ জামিনযোগ্য এবং ৯৮ ধারার অপরাধকে আপসযোগ্য বলা হয়েছে।
সব ধারায় শাস্তি শিথিল
আইনের ৯০ ধারায় মোটরযান পার্কিং এবং যাত্রী ও পণ্য ওঠানামার নির্ধারিত স্থান ব্যবহার-সংক্রান্ত বিধান লঙ্ঘনের দণ্ড উল্লেখ আছে। তাতে বলা আছে, এই বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং চালকের ‘দোষসূচক ১ পয়েন্ট’ কাটা যাবে। কিন্তু সংশোধনীর খসড়ায় এ অপরাধের জন্য মাত্র ১ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে, বাদ দেওয়া হয়েছে চালকের পয়েন্ট কাটার বিষয়টি। বিদ্যমান আইনে ভুয়া বা জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সের দণ্ড নির্ধারিত আছে ছয় মাস থেকে দুই বছরের জেল বা ১ থেকে ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড। সংশোধনীর খসড়ায় এটি সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ তিন মাসের জেল বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। সংশোধনীর খসড়ায় অর্থদণ্ড কমিয়ে ১৫ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। ট্রাফিক সংকেত না মানার শাস্তি উল্লেখ আছে সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে ‘দোষসূচক ১ পয়েন্ট’ কাটা হবে। এ ক্ষেত্রে কারাদণ্ড উঠিয়ে অর্থদণ্ড প্রস্তাব করা হয়েছে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা।
কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা কমানোর প্রস্তাবকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘কম শিক্ষিত, কিন্তু রোডসাইন যদি কেউ বোঝেন বা অভিজ্ঞতার আলোকে কাউকে লাইসেন্স দেওয়া হয়, সেটা খারাপ না। এতে দেশের ১০ লাখ চালক-সংকটের কিছুটা সমাধান হবে।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘এই আইন প্রণয়নের সঙ্গে শুরু থেকেই ছিলাম। ২০১১ সালের খসড়ার সঙ্গে ২০১৮ সালের আইনের ফারাক আকাশ-পাতাল। যে লক্ষ্য নিয়ে প্রথম খসড়া হয়েছিল, তার অনেক কিছুই বিদ্যমান আইনে নেই। অনেক ছাড় দিয়েই এটি করা হয়েছিল। তার পরও অংশীজনের মতামতের আলোকে আইনটি হয়। একটি পক্ষের নতুন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এখন আইন সংশোধন হচ্ছে, যেখানে কারও পর্যবেক্ষণ থাকবে না। এটা ভালো কিছু হচ্ছে না। এটি একটি গোষ্ঠীকে রক্ষা করার জন্য সমঝোতার দলিল হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংশোধনীতে যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে এটা দিয়ে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরানো, দুর্ঘটনা রোধ ও আইনভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।’
- বিষয় :
- সড়ক পরিবহন আইন
- সড়ক দুর্ঘটনা