জবি শিক্ষার্থীর মৃত্যু
দ্বীন ইসলাম ও আম্মানের খণ্ডিত সংশ্লিষ্টতা রয়েছে
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ

ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা
সমকাল ও জবি প্রতিবেদক এবং কুমিল্লা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৪ | ০০:১৮ | আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৪ | ১০:১১
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আইনের ছাত্রী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় তাঁর সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান ও বরখাস্ত সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের খণ্ডিত সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার খ মহিদ উদ্দিন গতকাল রোববার সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান।
অবন্তিকা আত্মহত্যার ঘটনায় শনিবার রাতে তাঁর মা তাহমিনা শবনম কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি মামলা করেছেন। ওই মামলায় অবন্তিকার সহপাঠী আম্মান ও শিক্ষক দ্বীন ইসলামকে আসামি করা হয়েছে। এ দু’জনকে আটকও করেছে পুলিশ। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার খ মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আম্মান ও দ্বীন ইসলামের খণ্ডিত সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তবে এ সংশ্লিষ্টতার গভীরতা কতখানি, সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তাদের কুমিল্লার কোতোয়ালি থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
সহপাঠীরা বলছেন, অবন্তিকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বিচার চেয়ে পাননি। তাঁর অভিযোগ আমলে নেওয়া হলে অবন্তিকা আত্মহত্যার পথ বেছে নিতেন না। যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে গত বছরের ১৪ নভেম্বর অবন্তিকা প্রক্টর অফিসে লিখিত অভিযোগ দেন। ওই অভিযোগপত্রে অবন্তিকা উল্লেখ করেন, দীর্ঘদিন ধরে সহপাঠী আম্মান তাঁর সঙ্গে হয়রানিমূলক আচরণ করছেন। একা পেয়ে তাঁকে শ্রেণিকক্ষে ও ছাদে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। রাজি না হওয়ায় আম্মান তাঁকে হুমকি দেন। কিন্তু তাঁর সে অভিযোগ আমলে নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ বিষটি তৎকালীন প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা জানতেন না।
অবন্তিকার সে অভিযোগ কেন আমলে নেওয়া হলো না– এমন প্রশ্নে তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামাল সমকালকে বলেন, ‘অবন্তিকা একটি অভিযোগ দিয়েছিল গত নভেম্বরে। পরে তাকে ডাকা হলে সে আর যোগাযোগ করেনি। তাই বিষয়টি নিয়ে পরে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও মনে করছেন, অভিযোগ বিষয়ে প্রক্টর অফিসের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল। আইন বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টা ও সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ ইহসানুল কবির বলেন, ‘বিষয়টি যেহেতু স্পর্শকাতর, তাই প্রক্টর অফিসের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন ছিল। দু’পক্ষকে ডেকে তদন্ত করা দরকার ছিল।’
অবন্তিকার আত্মহননের ঘটনায় তাঁর নিজের বিভাগের দায়সারা দায়িত্ব পালনের কথাও সামনে আসছে। তবে বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আলী আক্কাস দাবি করেন, তিনি একাধিকবার অবন্তিকার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আত্মহত্যার আগের দিনও অবন্তিকার সঙ্গে বিভাগে কথা হয়। কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, জানতে চেয়েছিলাম। সব কিছু ঠিকঠাক আছে বলে সে জানায়।’
জবির প্রক্টর অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেছেন, ঘটনাটি তিনি দায়িত্ব গ্রহণের আগের। এ বিষয়ে কেউ তাঁকে কিছু বলেনি। তবে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রথম সভা হয়েছে গতকাল। কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন বলেন, ‘প্রথম মিটিং করা হয়েছে। এতে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’
‘আমার মেয়েকে মানসিক নিপীড়ন করা হয়েছে’
অবন্তিকার মা তাঁর মামলায় বলেছেন, আম্মান বিভিন্নভাবে অবন্তিকার সঙ্গে যৌন হয়রানিমূলক আচরণ করত। বিষয়টি সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে জানানোর পরও তিনি উল্টো আম্মানের পক্ষ নিয়েছেন। এমনকি অবন্তিকাকে অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করেছেন। এ কারণে হোস্টেলে থাকা অনিরাপদ ভেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ছাত্রীদের মেসে থাকত অবন্তিকা। এতেও ক্ষান্ত হয়নি আম্মান। সহপাঠী লাকি আক্তার, রাফিসহ কয়েকজনের মাধ্যমে আমার মেয়ের চলাফেরায় নজরদারি করে তাকে মানসিক নিপীড়ন করে। দ্বীন ইসলাম অফিসে ডেকে নিয়ে অবন্তিকাকে জুতা দিয়ে মারার হুমকি দিয়েছেন বলেও মামলায় অভিযোগ করেন তাহমিনা শবনম।
অবন্তিকার মা বলেন, ‘আমার তিল তিল করে বড় করা স্বপ্ন ছিল অবন্তিকা। প্রশাসন দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে আজ মেয়েকে হারাতে হতো না। জবিতে আরও অনেক মেয়ে অবন্তিকার মতো হয়রানির শিকার হচ্ছে; কেউ ফেল করার ভয়ে মুখ খুলছে না। মেয়েকে তো ফিরে পাব না, তবে মেয়ের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার চাই।’
অবন্তিকাকে বাঁচানোর চেষ্টা
আত্মহত্যার বিষয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেখে অবন্তিকাকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন তাঁর সহপাঠীরা। তাঁর স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সহপাঠী ওই সময় তাঁর মোবাইল ফোনে কল করেন। তবে কারও কল রিসিভ করেননি অবন্তিকা। সহপাঠী মো. ফয়সাল গতকাল ফেসবুকে লিখেছেন সে কথা। তিনি লিখেছেন, ‘অবন্তিকার ফোনে রিং হয়, কিন্তু ফোন ধরেনি। পরে অবন্তিকার মায়ের ফোনে কল দেই। তখন অপর প্রান্তে কান্নাকাটির শব্দ।’
নতুন ৬ দফা দাবি শিক্ষার্থীদের
অবন্তিকার মৃত্যুতে সাবেক প্রক্টর মোস্তফা কামালকে তদন্ত সাপেক্ষে জবাবদিহির আওতায় আনাসহ নতুন ৬ দফা দাবি জানিয়েছেন জবির শিক্ষার্থীরা। গতকাল রাতে ক্যাম্পাসে মশাল মিছিল শেষে এ দাবি তুলে ধরেন তারা। দাবিগুলো হলো– অবিলম্বে আম্মান সিদ্দিকী ও দ্বীন ইসলামকে স্থায়ী বহিষ্কার, তৎকালীন প্রক্টরিয়াল বডি ও প্রক্টর মোস্তফা কামালসহ সবাইকে তদন্ত সাপেক্ষে জবাবদিহির আওতায় আনা, সব নিপীড়নের ঘটনার বিচার, নিরপেক্ষ নিপীড়ন দমন সেল গঠন ও প্রতি বিভাগে অভিযোগ বাক্স স্থাপন, ক্যাম্পাসে মনোবিশেষজ্ঞ নিয়োগ এবং সাত কর্মদিবসের মধ্যে সব দাবি পূরণ।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট গতকাল মুখে কালো কাপড় ও গলায় রশি বেঁধে প্রতীকী প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে। ছাত্র ফ্রন্টের নেতা ইভান তাহসিব এ সময় বলেন, ‘অবন্তিকার মৃত্যু সুইসাইড নয়; এটা হত্যাকাণ্ড। এখন ভিকটিম ব্লেমিং চলছে।’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন্দ্রীয় মসজিদে গতকাল অবন্তিকার আত্মার মাগফেরাতে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবীর চৌধুরীসহ শিক্ষক সমিতি ও প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা এতে উপস্থিত ছিলেন।
- বিষয় :
- শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার