ভয়াবহ হয়ে উঠতে যাচ্ছে বাংলাদেশের আর্সেনিক সমস্যা

হাতেপায়ে কেরাটোসিস অর্থাৎ শক্ত ফুসকুড়ি, ছোপ ছোপ দাগ, এমনকি 'ব্ল্যাকফুট ডিজিজ' যা থেকে দেহে পচনও ধরতে পারে- এসব লক্ষণ দেখা যায় আর্সেনিক বিষক্রিয়ায়। ছবি- সিএনএন
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৪ | ১৫:৫৩
শুরুটা হয় বুক-পিঠে ছোট ছোট দাগ দিয়ে। হাতের তালু, পায়ের পাতায় দেখা যায় শক্ত শক্ত ফুসকুড়ি। কারও কারও পায়ের আঙুল কালো হয়ে যায়।
বাংলাদেশের গবেষক এবং ডাক্তাররা এমন লক্ষণ প্রথম দেখেন আশির দশকে। তারা দ্রুতই বুঝতে পারেন এগুলো আর্সেনিক বিষক্রিয়ার লক্ষণ। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, একটি জনপ্রিয় জনস্বাস্থ্য প্রকল্পের ফল হলো এই বিষক্রিয়া।
সত্তরের দশকে বাংলাদেশ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে প্রচুর শিশু মারা যেত। ইউনিসেফ এবং আরও কিছু সংস্থার সহায়তায় সারা দেশে নলকূপ বসানোর প্রকল্প হাতে নেয় তৎকালীন সরকার।
দুই দশকের মাঝে লাখ লাখ নলকূপ বসানো হয় দেশজুড়ে। দ্রুতই কমে আসে শিশু মৃত্যুর হার। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে এসে জানা যায়, এসব নলকূপে যে পানি উঠে আসছে, তাতে রয়েছে বিপুল পরিমাণে আর্সেনিক। আর্সেনিক থেকে হতে পারে ক্যান্সার, হতে পারো আরও অনেক স্বাস্থ্য সমস্যা।
এত বেশি পরিমাণে মানুষের একসাথে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বিরল, বলেন ইতিহাসবিদরা। আর্সেনিকের সমস্যাটি সমাধানে যদিও সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে এসেছে, এরপরেও লাখ লাখ মানুষ আর্সেনিকের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নন। বাংলাদেশে প্রতি বছর আর্সেনিকের বিষক্রিয়া থেকে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যায় মারা যান অন্তত ৪৩ হাজার মানুষ।
নতুন গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, আর্সেনিকের সমস্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে যাচ্ছে। জলবায়ু বিপর্যয়ের বিভিন্ন প্রভাব, যেমন বন্যা, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি এসব কারণে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
এ সমস্যাটি যে শুধু বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে তা নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের গবেষকরা বলছেন সারা বিশ্বেই আর্সেনিক সমস্যা বাড়তে যাচ্ছে। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, চিলি, মেক্সিকো, এছাড়া ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক রয়েছে উচ্চ মাত্রায়। রঙহীন, গন্ধহীন, স্বাদহীন এই নীরব বিষ ধীরে ধীরে শরীরে জমা হয় ও ক্ষতি করতে থাকে। হাতেপায়ে কেরাটোসিস অর্থাৎ শক্ত ফুসকুড়ি, ছোপ ছোপ দাগ, এমনকি 'ব্ল্যাকফুট ডিজিজ' যা থেকে দেহে পচনও ধরতে পারে- এসব লক্ষণ দেখা যায় আর্সেনিক বিষক্রিয়ায়।
ত্বক পার হয়ে শরীরের ভেতরে নজর দিলে দেখা যায় আরও ভয়াবহ চিত্র। যকৃৎ, ফুসফুস, মূত্রথলির ক্যান্সার হতে পারে আর্সেনিক থেকে, অন্যদিকে হতে পারে হৃদ্রোগ এবং ডায়াবেটিস। গর্ভপাত, শিশুর বেড়ে ওঠায় সমস্যা, এবং ফুসফুসের সমস্যার পেছনেও থাকতে পারে আর্সেনিক।
দেহের প্রতিটি অঙ্গের ক্ষতি করে আর্সেনিক, বলেছেন আইসিডিডিআর,বি এর গবেষক রুবানা রাকিব।
এমনকি চেরনোবিলের চাইতে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে আর্সেনিকের এই বিষক্রিয়া, মনে করেন কিছু বিশেষজ্ঞ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অন্তত ৭০টি দেশের ১৪ কোটি মানুষ পান করছেন বিষাক্ত আর্সেনিকযুক্ত পানি। পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা প্রতি লিটারে ১০ মাইক্রোগ্রামের বেশি হলে তা পান করার অনুপযুক্ত এবং বিষাক্ত ধরা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে এক লিটার পানিতে ৫০ মাইক্রোগ্রামের বেশি আর্সেনিক থাকলে সেটাকে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। সে হিসেবেও লাখ লাখ মানুষ আর্সেনিক বিষক্রিয়ার ঝুঁকিতে আছেন।
১৯৯৮ সালে পরিচালিত বিশাল এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ২৭ শতাংশের বেশি অগভীর নলকূপে উঠে আসে বিষাক্ত আর্সেনিকযুক্ত পানি। এতে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ।
বাংলাদেশে আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকার ম্যাপ তৈরিতে জড়িত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নরউইচ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ অধ্যাপক সেথ ফ্রিজবি। তিনি বলেন, আমি এমন গ্রামেও গেছি যেখানে ৩০ বছরের ওপর কেউ বেঁচে নেই। তার মতে, খুব কম পরিমাণে আর্সেনিকও আসলে নিরাপদ নয়। কম পরিমাণে শরীরে প্রবেশ করলেও তা মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
দুঃখের বিষয় হলো, এত গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যার দিকে কর্তৃপক্ষের তেমন মনোযোগ নেই। আর্সেনিক বিষয়টা স্তিমিত হয়ে গেছে, আইসিডিডিআর,বি এর গবেষক রুবানা রাকিব বলেন। এ বিষয়ে সবাই জানে, কিন্তু সমস্যাটা সমাধানে উদ্যোগ নিচ্ছে না কেউ।
বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই ইউনিসেফ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে দাবি করেছে। তারা সরকারের সাথে ৩০ বছর ধরে নলকূপ পরীক্ষা করছে, এ বিষয়ে সচেতনতা ছড়াতে কাজ করছে। তবে পানি থেকে আর্সেনিক আলাদা করার কোনো প্রযুক্তিই এখনো পর্যন্ত তেমন একটা কার্যকরী নয়।
তাহলে এই সমস্যার সমাধান কী?
একটাই সমাধান, তা হলো গভীর নলকূপ স্থাপন। অনেকেই এখনো অগভীর নলকূপ স্থাপন করেন কারণ তাতে অর্থ ও শ্রম দুটোই কম খরচ হয়। এতে আর্সেনিক ঝুঁকি তো রয়েই যায়, আর তা পান করলে ক্যান্সারের সম্ভাবনাও থাকে বেশি।
সুত্র: সিএনএন
- বিষয় :
- আর্সেনিক
- স্বাস্থ্যঝুঁকি
- পানি
- দিবস
- গবেষণা
- জলবায়ুর পরিবর্তন