প্রতিরোধ দিবস পালনের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু
বিশেষ লেখা

মুনতাসীর মামুন
মুনতাসীর মামুন
প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৪ | ০২:১২ | আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৪ | ০৯:০৩
কলাভবনে ২ মার্চ বাংলাদেশের তখনকার পতাকা উত্তোলন করা হয়। যখন কোনো ভূখণ্ডে এ রকম ঘটে, তার অর্থ দাঁড়ায়– তারা আর পুরোনো পতাকার নিচে থাকতে আগ্রহী নয়। তারা বিদ্রোহী। ওই পতাকা ১৯৭২ সালের পূর্ব পর্যন্ত ছিল বাংলাদেশের পতাকা।
ছেলেবেলায় স্কুলে ‘পাকিস্তান দিবস’ পালিত হতো ভালোভাবেই। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ বাংলার এ কে ফজলুল হক লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। সেই স্মৃতিকে স্মরণ করে পালিত হতো ‘পাকিস্তান ডে’ বা ‘পাকিস্তান দিবস’।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ সকালে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি, প্রায় বাড়িতেই পাকিস্তানি পতাকার বদলে কালো পতাকা। পাকিস্তান দিবসে সরকারিভাবে তো বটেই বেসরকারি ভবন, বাড়িতে পতাকা উত্তোলিত হতো। ওই যে ২৩ তারিখে পাকিস্তানি পতাকার নির্বাসন ঘটল, তা আর ফিরে আসেনি বাংলাদেশে।
২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের অধিবেশনে বাংলার এ কে ফজলুল হক বিখ্যাত লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাঁর ৩১ বছর পর আরেক বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান ২৩ মার্চ ঘোষণা করলেন প্রতিরোধ দিবস। বঙ্গবন্ধু এই দিনটিকে ছুটি ঘোষণা করেছিলেন এবং প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। সবার বাসায় এর আগে উঠানো হয়েছিল কালো পতাকা, এখন তার পাশে উঠল বাংলাদেশের পতাকা।
২৩ মার্চ ছাত্রলীগ ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সঙ্গে সঙ্গে পতাকা উত্তোলন করে। এ সময় ১০ প্লাটুন ‘জয় বাংলা বাহিনী’ সামরিক কায়দায় পতাকাকে অভিনন্দন জানায়। এই ১০ প্লাটুনের মধ্যে ছিল নারী প্লাটুন, কিশোর প্লাটুন ও প্রাক্তন সৈন্যদের প্লাটুন। সামরিক ছাউনি ও সবখানে উড়ছিল কালো ও বাংলাদেশের পতাকা। পত্রিকার প্রতিবেদন– “কাকডাকা ভোর হইতে রাজপথ জনগণ প্লাবিত করিয়া শহরগুলির বিভিন্ন দিক হইতে দশ ঘণ্টা সময়ে ৬টি মহিলা মিছিলসহ অন্তত ৫৫টি ছোট-বড় মিছিল গতকাল শেখ সাহেবের বাসভবনে আগমন করিয়া মহান জাতির মহান নেতার প্রতি অকুণ্ঠ অবস্থার পুনরাবৃত্তি ও সংগ্রামের দুর্জয় শপথের স্বাক্ষর রাখিয়া যায়। সেই মিছিল সদস্যের হাতে হাতে লাঠি, বন্দুক, বল্লম, চোখেমুখে মুক্তির দীপ্ত তারুণ্য আর কণ্ঠে কণ্ঠে নয়া দিনের নব জাতির নতুন দেশের বিজয়গাথা, কোটি প্রাণের অমোঘ সংগীত ‘জয় বাংলা’ সাধন মন্ত্রে গর্জিয়া উঠিতে থাকে। তেইশ বছর ধরিয়া বাংলার দশ দিগন্তে যে শান্তি পতাকা উড়িয়াছে, যে পাকিস্তান দিবস পালিত হইয়াছে, যেভাবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সভা-সমিতি হইয়াছে, আর সেইসব অনুষ্ঠানে, রাজপথে, জনপথে অধিকারবঞ্চিত গণমানুষ ক্ষ্যাপা পাগলের মতো পাকিস্তানে তাদের স্বাধীনতা খুঁজিয়া বেড়াইয়াছে। গতকালের দিনটি তাহার তমাসবাসনের সূচনা করিয়া জনতাকে নবসূর্যের নব আলোকে নয়া পতাকার দিকনির্দেশে প্রাণের টানে টানিয়া নিয়াছে জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। আর বাঁ হাতে বাংলাদেশের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলিয়া ডান হাত জনতার দিকে বাড়াইয়া দিয়া বাংলার মুকুটহীন সম্রাট সাড়ে সাত কোটি মানুষের আত্মার সুজনকে একত্রে জড়ো করিয়া গর্জিয়া উঠিয়াছেন। ‘বাংলার মানুষ কাহারো করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতার বলেই তাহারা মুক্তি ছিনাইয়া আনিবে। জয় বাংলা/বাংলার জয় অনিবার্য’।”
ছাত্রলীগের সদস্যরা তাঁকে অভিবাদন জানায় বাসার সামনে। তিনি বলেন, “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। যতদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হইবে। যতদিন একজন বাঙালি বাঁচিয়া থাকিবে, এই সংগ্রাম আমাদের চলিবেই চলিবে। মনে রাখিবেন, সর্বাপেক্ষা কম রক্তপাতের মাধ্যমে যিনি চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করিতে পারেন, তিনিই সেরা সিপাহসালার। তাই বাংলার জনগণের প্রতি আমার নির্দেশ, সংগ্রাম চালাইয়া যান। শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। সংগ্রামের কর্মপন্থা নির্ধারণের ভার আমার উপরই ছাড়িয়া দিন... বাংলার দাবির প্রশ্নে কোনো আপস নাই। বহু রক্ত দিয়াছি। প্রয়োজনবোধে আরও রক্ত দিব। কিন্তু মুক্তির লক্ষ্যে আমরা পৌঁছিবই। বাংলার মানুষকে আর পরাধীন করিয়া রাখা যাইবে না।”
“আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। কিন্তু যদি তা সম্ভব না হয়। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাঁচিয়া থাকার লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম আমাদের চলিতেই থাকিবে। এই সংগ্রামের পন্থা কী হইবে উহা আমিই ঠিক করিয়া দিব। সে আমার উপর ছাড়িয়া দিন। শেষ কায়েমি স্বার্থবাদীদের কীভাবে পর্যুদস্ত করিতে হয়, আমি জানি।”
বাংলাদেশের যে পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল ২৩ মার্চ, তা নিয়ে একটি রিপোর্ট করে দি পিপল।
A NEW FLAG IS BORN
A new flag is born today, a flag with a golden map of Bangladesh implanted on red circle placed in the middle of the deep green rectangle shape. This is the latest flag added to the total list of the flag representing various states and Nation of the contemporary world. This is the flag for Independent Bangladesh. This is the flag that Symobolises the emancipation of 75 million Bengadesh.
আর্চার ব্লাড লিখেছেন, ব্রিটিশ ও সোভিয়েতরা নিজেদের পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকাও উত্তোলন করেছে। ইরানি, নেপালি এবং ইন্দোনেশীয়রা নিজেদের পতাকা উত্তোলন করেছে। চীনারা নিজেদের পতাকা উত্তোলন করেছিল, পরে ছাত্রদের চাপে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যরা বিতর্ক এড়াবার জন্য কোনো পতাকাই ওড়ায়নি। নেপালিরা পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়েছিল। ছাত্রদের দাবির মুখে তা নামিয়ে পতাকাটি ছাত্রদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়। ছাত্ররা তাঁর বাসার সামনে পতাকা পুড়িয়ে দেয়।
২৩ তারিখে আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের দু’বার বৈঠক হয়। কোনো সমঝোতা হয়নি। প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল তাও তিনি দেননি। ওই দিন রাতে সৈয়দপুর ও ঢাকার মিরপুরে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা বেধে যায়। সেনাবাহিনী দাঙ্গা রোধে গুলিবর্ষণ করলে অনেকে নিহত হন। বঙ্গবন্ধু আবারও বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা গোলমাল বাধাবার চেষ্টা করছে। “আমার মাথা কেনার শক্তি কারো নেই। শহীদের রক্তের সাথে বেইমানি করতে পারব না। জয় বাংলা-ই থাকবে। আর কেউ ক্ষয় বাংলা করতে পারবে না।”
বিজেনজো লিখেছেন, ইয়াহিয়ার সঙ্গে কথা বলে তাঁর মনে হয়েছিল, মুজিবের প্রস্তাবে তিনি সায় দেবেন। ওই দিন রাতেই তিনি ও ওয়ালি খান দেখা করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু তাদের বললেন, জেনারেলের ‘মুড’ ঘন ঘন বদলাচ্ছে এবং তা ডিকটেবল হয়ে উঠছে। বললেন তিনি “আমি আর এক বা দুই পরিষদ ডাকার কথা বলব না। আমি বলব, এখনই সামরিক আইন প্রত্যাহার করে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করব। মূল বিষয় সামরিক আইন প্রত্যাহার ও আমার দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।”
বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা তারা আবার পৌঁছালেন ইয়াহিয়ার কাছে। ইয়াহিয়া বললেন, “যদি আপনাদের বন্ধু ঠিকমতো ব্যবহার না করে তাহলে সেনাবাহিনী জানে কীভাবে গুলির মাধ্যমে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে হয়।” বিজেনজো বললেন, “জনাব প্রেসিডেন্ট আপনি কি মনে করেন এই স্পর্শকাতর বিষয়ের সামরিক সমাধান সম্ভব? উত্তরে তিনি বললেন, ‘না’।”
জানতাম না আমরা তখন যে, আর দু’দিন বাদে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম গণহত্যা শুরু হবে এ দেশে। জানতাম না এর পরদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন।
লেখক: ইতিহাসবিদ ও শিক্ষক
- বিষয় :
- বঙ্গবন্ধু
- মুনতাসীর মামুন
- ছাত্রলীগ