ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

ইশতেহার পূরণে সদিচ্ছা কম, দরকার মনিটরিং সেল

ইশতেহার পূরণে সদিচ্ছা কম, দরকার মনিটরিং সেল

.

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৪ | ০০:৪৩ | আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৪ | ০৮:৪৩

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, শিক্ষার মানোন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনেক প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। শিক্ষার মানের কথা বললে এটা এতটাই নিচে নেমেছে, প্রাথমিকের অনেক শিক্ষার্থীই বাংলা বর্ণ ও গণিতের সংখ্যা চিনতে পারে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রার বিনিময় হারে অসামঞ্জস্যতা এবং আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিল্প খাতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার অভাবও স্পষ্ট। সার্বিকভাবে বললে, দেশের সরকারগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন হয় না। জনগণকে দেওয়া এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এজন্য ইশতেহার বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণে একটি মনিটরিং সেল গঠনের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

‘আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক ইশতেহার উন্মোচন: আগামীর বাংলাদেশের প্রবণতা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেছেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের কার্যালয়ে গতকাল রোববার এ সেমিনার আয়োজন করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)।

এতে মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, শিক্ষার মানোন্নয়ন, স্বাস্থ্য, কৃষি প্রভৃতি বিষয়ে আটটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের গবেষকরা। এতে বলা হয়, ইশতেহারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কিছু কিছু কাজ হলেও এখনও বড় দুর্বলতা রয়ে গেছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে শিক্ষার মান এতটাই নিচে নেমেছে, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির অর্ধেক শিক্ষার্থীই বাংলা বর্ণ ও গণিতের সংখ্যা চিনতে পারে না। আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ ডিগ্রি অর্জন শেষ করার তিন বছর পরও ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মুদ্রার বিনিময় হারে অসামঞ্জস্যতা। আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিল্প খাতে রয়েছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার অভাব। চিকিৎসার ক্ষেত্রে জনগণকে নিজের পকেট থেকে ৭৭ শতাংশ ব্যয় করতে হয়, যা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। অথচ এসব বিষয় থেকে উত্তরণের প্রতিশ্রুতি ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে।

অর্থনৈতিক বিষয়ে ইশতেহার বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ সরকার কতটা সফল, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য না দিলেও সেমিনারে প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী দাবি করেন, সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি ভালো হয়ে আসছে। তিনি বলেন, কয়েকদিন আগেও বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে– এমন সমালোচনা শুরু হলেও এমনটি হয়নি। ইতোমধ্যে দেশে ডলার আসার প্রবাহ বেড়েছে। অফশোর ব্যাংকিংয়ের নতুন আইন পাস হওয়ার পর বিদেশিদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন। অর্থনীতির পরবর্তী পর্যায়ে উন্নয়নকে টেকসই করতেসরকার কাজ করছে।

পরিকল্পনামন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) আবদুস সালাম বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ ১১টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। এ ছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত, আর্থিক খাত সংস্কার ও এসডিজি অর্জনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এসব দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার।

প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন, গত পাঁচ থেকে ছয় বছর ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখা হয়েছিল। সে সময় রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের প্রবাহ ভালো থাকায় সমস্যা হয়নি। কিন্তু গত এক বছরে এ ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও দীর্ঘ মেয়াদে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুল্ক ছাড়ের বিষয়ে আরও পর্যালোচনা দরকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ ধরনের শুল্ক ছাড়ের বিষয়ে উৎপাদনশীলতা কতটুকু বাড়ছে, তা দেখতে হবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। যুদ্ধের নামে গত তিন বছরে বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত ১৪ বিলিয়ন ডলার ডাকাতি করে নিয়ে গেছে। বিশ্ব পরিস্থিতি এবং ভূরাজনৈতিক কারণে জনগণকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, শিক্ষার গুণগত মানে দুর্বলতা রয়েছে, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তিনি দাবি করেন, নানা সীমাবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ইশতেহারের আলোকেই এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। এসব উদ্যোগের মূল্যায়নে একটি মনিটরিং সেল গঠন হতে পারে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার কমিটির সদস্য শেখর দত্ত বলেন, রাজনীতি ও অর্থনীতি একে অপরের উপযোগী না হলে সমস্যা আরও গভীর হয়। বঙ্গবন্ধুর আমলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল থাকলেও রাজনৈতিক দিক দিয়ে অনেক শক্তিশালী ছিল। এখন অর্থনৈতিকভাবে অনেক উন্নয়ন হলেও রাজনীতি পিছিয়ে গেছে। ভোট হয় শুধু সংবিধানের নিয়ম রক্ষায়। নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার কথা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন শতভাগ সুযোগ-সুবিধা তারাই নিতে চায়। বর্তমান সরকারেরও একই অবস্থা। এভাবে গণতন্ত্রের উন্নয়ন সম্ভব নয়।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ বলেন, নির্বাচনী ইশতেহার দলগুলোর রাজনৈতিক দলিল। কিন্তু বড় সমস্যা হচ্ছে, এ দলিল রক্ষায় তেমন কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। অনেক সময় রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই এগুলো বাস্তবায়ন হয় না। শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখার বিষয়ে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে আনুপাতিক হারে তা কমেছে।

শিক্ষাবিদ ড. আহমেদ হাসান বলেন, প্রতিবছর শিল্প খাতে ২০ লাখ কর্মসংস্থানের কথা বলা হলেও সরকারি বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে এ খাতে কর্মসংস্থান কমেছে। আসলে নির্বাচনী ইশতেহার পরে কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে, এ বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন।

বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন তাঁর প্রবন্ধে বলেন, করোনাকালে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৩ শতাংশে নেমে যায়। বাকি সময়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে তা কমে গেছে। রপ্তানি বাড়লেও তা আশানুরূপ হয়নি। কর-জিডিপির অনুপাত ৮ শতাংশের কাছাকাছি। গত নির্বাচনী ইশতেহারে ১৫ থেকে ১৭ শতাংশে উন্নীতের পরিকল্পনা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি।

আরও পড়ুন

×