ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ওয়ার্ড বয়-নার্সরাই ভরসা

কর্মবিরতিতে চিকিৎসক, দুর্ভোগে রোগী

অনেক হাসপাতালে বন্ধ অস্ত্রোপচার

কর্মবিরতিতে চিকিৎসক, দুর্ভোগে রোগী

ডাক্তারদের কর্মবিরতির কারণে রোগী দেখা বন্ধ। বহির্বিভাগে ভিড়। সোমবার মানিকগঞ্জ কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সমকাল

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৪ | ০০:৩৩ | আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৪ | ১০:১৮

মাসিক ভাতা ২৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করাসহ চার দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালন করছেন পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। এতে সারাদেশে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা, ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অনেক হাসপাতালে বন্ধ রাখা হয়েছে অস্ত্রোপচার। 

গতকাল সোমবার বেলা ১১টায় ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের বহির্বিভাগে ১১ নম্বর কক্ষের সামনে রোগীর লম্বা লাইন। সুমন রহমান নামে একজন বলেন, ‘সকাল ৯টায় লাইনে দাঁড়িয়েছি, ডাক্তার এখনও আসেননি। কখন আসবেন, সেটি কেউ বলতে পারছেন না।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসক না থাকায় এদিন ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগের প্রতিটি কক্ষে চিকিৎসক দেওয়া সম্ভব হয়নি। খুব জরুরি না হলে অস্ত্রোপচারও হচ্ছে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এত চিকিৎসক কাজে অনুপস্থিত থাকায় হাসপাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।’

কর্মবিরতি প্রসঙ্গে পোস্টগ্র্যাজুয়েট প্রাইভেট ট্রেইনি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. জাবির হোসেন বলেন, ‘ভাতা বাড়ানোর বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ দেননি। তাই আমাদের এই কর্মবিরতি। এর পরও দাবি আদায় না হলে আমরা রাজপথে নামব।’

ঢাকার বাইরের হাসপাতালেও কর্মবিরতি পালন করছেন ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। এর ফলে সারাদেশেই বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বুকে ব্যথা নিয়ে গত রোববার খুলনা মেডিকেলে ভর্তি হন বটিয়াঘাটার খারাবাদ বাইনতলা গ্রামের সবুর মিয়া। ওইদিন সকাল ১০টার দিকে চিকিৎসক দেখে তাঁকে ব্যবস্থাপত্র দেন। এর পর গতকাল বেলা ১১টা পর্যন্ত আর কোনো ডাক্তার তাঁকে দেখেননি। সবুর মিয়ার মেয়ে শামীমা সুলতানা বলেন, ‘বাবার বুকে ব্যথা হচ্ছে। ডাক্তাররা নাকি ধর্মঘট করছেন! এখন কী করব বুঝতে পারছি না।’ এখানকার আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার বলেন, ‘৫০০ শয্যার এই হাসপাতালে রোগী ভর্তি প্রায় ১ হাজার ৩০০। সেই অনুপাতে চিকিৎসক নেই! এর মধ্যে অনেক চিকিৎসক কর্মবিরতিতে গেছেন। তাই রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

চার দফা দাবিতে টাঙ্গাইলের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কর্মবিরতি পালন করছেন। এখানে ভর্তি আছেন টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের সমির চন্দ্র। তাঁর মেরুদণ্ডের হাড়ের ব্যথা। সমির বলেন, ‘দুই দিন চিকিৎসা ভালোই চলছিল। হঠাৎ ইন্টার্ন ডাক্তাররা কাজ বন্ধ করে দেওয়ায় কেউ আর দেখতে আসছেন না।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন ৫২ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করেন। হঠাৎ করে তারা কর্মবিরতি শুরু করায় অন্য চিকিৎসকরা চাপে পড়েছেন। রোগী দেখার পাশাপাশি তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এমনকি রোগী ভর্তির কাজও করতে হচ্ছে।

ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে রংপুর মেডিকেলেও রোগীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। অনেক রোগী চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন তাদের স্বজনরা। মেডিকেলের সামনে গতকাল মানববন্ধন করেন কর্মবিরতিতে থাকা চিকিৎসকরা।

গোপালগঞ্জে শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে গতকাল কর্মবিরতিতে থাকা চিকিৎসকরা ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় বিভিন্ন দাবি-সংবলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন তারা। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, ‘একটি হাসপাতালের প্রাণ হলো ইন্টার্ন চিকিৎসক। অথচ তাদের ভাতা অনেক কম। তাই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’
কর্মবিরতিতে রয়েছেন বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরাও। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন এখানকার রোগীরা। জেলার সারিয়াকান্দির শরিফুল ইসলাম ভর্তি রয়েছেন এই হাসপাতালে। দুর্ঘটনায় ডান পায়ে আঘাত পেয়েছেন তিনি। শরিফুল বলেন, ‘ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছি না, হাসপাতালে ডাক্তার কম।’ ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে শজিমেকে চিকিৎসা কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে বলে মনে করছেন অনেক রোগীর স্বজন। তারা বলছেন, ‘ওয়ার্ড ও নার্সরাই এখন ভরসা।’ এই হাসপাতালে সব সময় দেড় হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থাকে। এ ছাড়া বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয় কয়েক হাজার রোগী।

মানিকগঞ্জ কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজেও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা গতকাল দাবি আদায়ে কলেজের সামনে মানববন্ধন করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, ‘স্নাতকোত্তর বেসরকারি ট্রেইনি চিকিৎসকদের ভাতা বাড়ানোর দাবিটি যৌক্তিক। কিন্তু রোগীদের জিম্মি করে কর্মবিরতি করা উচিত নয়। আলোচনা ও সমঝোতা করেই দাবি আদায় করা উচিত।’

কর্মবিরতি পালনকারী ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের অন্য দাবিগুলো হলো– এফসিপিএস, রেসিডেন্ট ও নন-রেসিডেন্ট ডাক্তারদের বকেয়া ভাতা পরিশোধ; বিএসএমএমইউর অধীন ১২ প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে রেসিডেন্ট ও নন-রেসিডেন্ট ডাক্তারদের ভাতা পুনরায় চালু এবং চিকিৎসক সুরক্ষা আইন সংসদে পাস ও বাস্তবায়ন। এসব দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন সারাদেশের প্রায় ৭ হাজার ট্রেইনি ও সাড়ে ৩ হাজার ইন্টার্ন চিকিৎসক।

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সমকালের সংশ্লিষ্ট ব্যুরো, অফিস ও প্রতিনিধি)

 

আরও পড়ুন

×