ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

‘শান্তি আলোচনা’র মধ্যে চরমপন্থায় কেএনএফ

‘শান্তি আলোচনা’র মধ্যে চরমপন্থায় কেএনএফ

ছবি: ফাইল

সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম; সত্রং চাকমা, রাঙামাটি ও উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা, বান্দরবান

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৪ | ০৫:৪৮ | আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২৪ | ০৯:৩৪

বান্দরবানে ব্যাংক ডাকাতির পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। বছর দুয়েক আগে পার্বত্য এলাকায় তারা নানা তৎপরতা শুরু করে। চাঁদার দাবিতে অনেককে জিম্মিও করে। পাহাড়ে তাদের আস্তানায় জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যদের অর্থের বিনিময়ে প্রশিক্ষণও দেয় তারা। 

গত বছর গহিন জঙ্গলে কেএনএফের আস্তানায় অভিযান চালিয়ে তাদের এবং শারক্কীয়ার বেশ কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সঙ্গে গত ৫ মার্চ দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয় বেথেলপাড়ায়। কিন্তু শান্তি আলোচনা চলার মাঝপথে কেএনএফ হঠাৎ কেন চরমপন্থা বেছে নিল– তা নিয়ে চলছে জল্পনা। তাদের এ কার্যক্রমের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে শান্তি আলোচনার উদ্যোগও। রাঙামাটি ও বান্দরবানের ৯টি উপজেলা নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য গঠনের ঘোষণা দিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল এ সংগঠনের। এর পর থেকে নানা ইস্যুতে অশান্ত হচ্ছে বান্দরবান।

কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে আগামীকাল ৫ এপ্রিল হওয়ার কথা ছিল আরেকটি বৈঠক। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লার নেতৃত্বে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতাদের নিয়ে ২০২৩ সালের জুন মাসে ১৮ সদস্যের শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়। এর পর থেকে দফায় দফায় দু’পক্ষের মধ্যে ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম সরাসরি বৈঠকে চারটি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। দ্বিতীয় বৈঠকে ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়। এভাবে ধীরে ধীরে শান্তির পথে এগোচ্ছিল সবাই। তবে হঠাৎ অবস্থান পাল্টে চরমপন্থা বেছে নিল কেএনএফ।

বুধবার রাজধানীতে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘কেএনএফ দেশের জঙ্গিদের সঙ্গে আঁতাত করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। সেনাবাহিনী ও র‍্যাব অভিযান চালিয়ে তাদের সরিয়ে দিয়েছিল। ইদানীং আমরা দেখছিলাম, কুকি-চিন আবার বিভিন্নভাবে তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছিল।’ একের পর এক ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা শান্তি আলোচনার উদ্যোগে প্রভাব ফেলবে কিনা– এ প্রশ্নের জবাবে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। অবস্থা বুঝে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। 

ফের অশান্ত হলো এপ্রিল

গত বছরও এপ্রিল মাসে রক্তাক্ত হয়েছিল বান্দরবান। ৭ এপ্রিল রোয়াংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের খামতাংপাড়া এলাকায় একসঙ্গে পড়েছিল আট লাশ। পাহাড়ের দুই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনাতেই সেবার রক্তাক্ত হয়েছিল পাহাড়। ঘটনার পর কেএনএফ তাদের ভাটি কুকি নামে ফেসবুক পেজে দাবি করেছে, নিহত আটজনের মধ্যে সাতজন তাদের দলের সদস্য। নিহত ছয়জন উপজেলার জুরভারাংপাড়া এবং একজন পানখিয়াংপাড়ার বাসিন্দা। তবে এবার আতঙ্ক ছড়ানোর কারণ পুরোপুরি ভিন্ন।

হঠাৎ যেভাবে আলোচনায় আসে কুকি-চিন 

কেএনএফ প্রথম আলোচনায় আসে ২০২২ সালের ২১ জুন। সেদিন রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার ৪ নম্বর বড়থলি ইউনিয়ন ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাইজামপাড়া গ্রামে এক দল কেএনএফ সদস্যের ব্রাশফায়ারে তিনজন নিহত হন। এ সময় দুই শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। এ ঘটনার পর থেকে কেএনএফ  আলোচনায় উঠে আসে। স্থানীয়ভাবে কুকি-চিন ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত। তাদের সামরিক শাখার নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)। সংগঠনটির প্রধান নাথান বম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র। 

কেএনএফ কী চায় পাহাড়ে

নাথান বম ২০০৮ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৯ সালের দিকে এই নাম পাল্টে করা হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। সংগঠনটি রাঙামাটি ও বান্দরবানের যে ৯টি উপজেলা নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য গঠনের ঘোষণা দিয়েছে, এর মধ্যে আছে বান্দরবান জেলার রুমা, থানচি, লামা, রোয়াংছড়ি ও আলীকদম উপজেলা; রাঙামাটির সাজেক উপত্যকা, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলা। তাদের মতে, এ স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যে বসবাস করতে পারবে একমাত্র বম, খুমি, খিয়াং, পাংখোয়া ও লুসাই– এ পাঁচ সম্প্রদায় বা জাতির জনগোষ্ঠী। এই রাজ্যে মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বসবাস করতে পারবে না। এখানে তঞ্চঙ্গ্যাদের চাকমা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। তাই তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নাম উল্লেখ নেই। তখনই কেএনএফ তাদের সাংগঠনিক প্রধান হিসেবে নাথান বমের নাম ঘোষণা করে। বমের বাড়ি বান্দরবান। বম অ্যাসোসিয়েশন কাউন্সিলের সভাপতি লালদা সাং বমের মতে, পাঁচ-ছয় বছর আগে তাদের লোকসংখ্যা ২৫ হাজারের মতো ছিল। তবে কেএনএফের সশস্ত্র শাখায় দেড় হাজারের মতো সদস্য রয়েছে। সশস্ত্র সদস্যদের সন্ত্রসীরাও এ সশস্ত্র শাখার সদস্য।

কেএনএফের যত সংঘাত 

২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যটন স্পট বগালেক পাড়া থেকে ব্যবসায়ীর গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। স্থানীয়দের ধারণা, কেএনএফ সশস্ত্র সদস্যরা তাকে অপহরণের পর গুলি চালিয়ে হত্যা করে। গত ১১ মার্চ কেএনএফ সদস্যরা গুলি চালিয়ে এক ট্রাকচালক ও তাঁর সহকারীকে আহত করে। গত ১৩ মার্চ কেএনএফের হামলায় এক সেনাসদস্য নিহত ও দু’জন আহত হন। গত ১৪ মার্চ কেএনএফ সদস্যরা রুমা অঞ্চলের একটি সেতু বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। গত ১৭ মার্চ সাবেক এক সেনাসদস্যসহ তিনজনকে অপহরণ করে সংগঠনটি। গত ২২ মার্চ রোয়াংছড়িতে বম পাড়াপ্রধানের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ৭ এপ্রিল রোয়াংছড়ি-রুমা সড়কের খামতাংপাড়ায় দুটি সশস্ত্র সংগঠনের (কেএনএফ ও ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় আটজন নিহত হয়। সে সময় পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, নিহত ওই আটজনই বম সম্প্রদায়ের। স্থানীয়রা জানিয়েছে, গত ৮ মে রোয়াংছড়ি থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে পাইক্ষ্যংপাড়া এলাকা থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতদের একজন সদর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি। অন্য দু’জন সাধারণ নাগরিক। ২০২৩ সালের অক্টোবরে কেএনএফের হামলায় পাঁচ সেনাসদস্য নিহত হন। পরে কেএনএফের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠনের যোগসাজশ রয়েছে দাবি করে যৌথ বাহিনী অভিযান চালায়। এ সময় জামাআতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৬৮ জন জঙ্গি ও কেএনএফের বেশ কয়েকজনকে আটক করে। এ সময় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এতে কেএনএফের সদস্যরা প্রায় সাত মাস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিরত থাকলেও আবারও সক্রিয়  হয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে তারা।

কে এই নাথান বম

পুরো নাম নাথান লনচও বম। তার বাড়ি রুমা উপজেলার ইডন বমপাড়া। তাঁর স্ত্রী বর্তমান রুমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্স হিসেবে দায়িত্বে আছেন। তাঁর দুই সন্তান। নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ঢাকা মহানগর শাখা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে ২০০৮ সালে বম, লুসাই, পাংখায়া, খিয়াং, খুমি, ম্রো প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর তথাকথিত অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে কুকি-চিন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজশন নামে একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন গঠন করেন। তিনি এ সংগঠনের সভাপতি ও ভাঙচুনলিয়ান বম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অভিযোগ রয়েছে, কেএনএফ পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী পাংখোয়া, খুমি, খিয়াং, ম্রো, বম ও লুসাই জনগোষ্ঠীকে নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত  একটি রাজ্য গঠনের স্বপ্ন দেখছে। 

‘কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি-কেএনএ’ নামে ফেসবুক পেজ থেকে গত ১২ মার্চ এক পোস্ট করা হয়। বলা হয়, ‘চুক্তি ভঙ্গ করে বম সম্প্রদায়ের নিরীহ জনগণ লালমুয়ানওম বম (গিলগাল বা অবচলিতপাড়া) এবং রামনুয়াম বমকে (দুনিবারপাড়া) আটক করেছে। এর ফল খুব সুন্দরভাবে ফিডব্যাক দেওয়া হবে নিরীহ জনগণকে হয়রানি বন্ধ করা না হলে।’ ওই হুমকির পর মঙ্গলবার রাতে ব্যাংক ডাকাতিতে জড়াল কেএনএফ। 

আরও পড়ুন

×