ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বিষাদময় ঈদ তাদের

বেইলি রোড ট্র্যাজেডি 

বিষাদময় ঈদ তাদের

৩ নাতি-নাতনিকে হারিয়ে এখনও বাকরুদ্ধ তাদের দাদি - ফাইল ছবি

বকুল আহমেদ, আব্দুল হামিদ ও ইয়াসির আরাফাত

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৪ | ০৭:২৪

‘মেহেরুন আমার মেয়ে ছিল না, সাক্ষাৎ মা। দূরে গেলে কিছুক্ষণ বাদে বাদে ফোন করে খবর নিত। খাবার খেয়েছি কিনা, ওষুধ খেতে ভুলে গেছি কিনা ইত্যাদি। শিশুদের মতো গুনে গুনে বুঝিয়ে বলত– দেখেশুনে রাস্তা পার হবে। সবাই আছে, শুধু আমাকে বোঝে এমন আর কেউ নেই। ঈদ আসছে, মেহেরুনের শূন্যতা আরও বেশি অনুভব করছি।’ মুক্তার আলম হিলালী গতকাল শনিবার মোবাইল ফোনে যখন কথাগুলো বলছিলেন, তার গলা ধরে আসছিল। আর তা এ প্রান্ত থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। 

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডে ‘গ্রিন কোজি কটেজে’ অগ্নিকাণ্ডে মুক্তার আলমের বড় মেয়ে মেহেরুন নেসা জাহান হিলালী, জামাতা শাহজালাল উদ্দিন ও সাড়ে তিন বছরের নাতনি ফায়রুজ কাশেম জামিরা মারা যায়। কাস্টমস কর্মকর্তা শাহজালাল স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সেদিন ওই ভবনের রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন। শাহজালাল কক্সবাজারের উখিয়া থানার মরিচ্যা গ্রামের সন্তান হলেও পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে। বেইলি রোডের ওই আগুনে তাদের মতো আরও ৪৬ জনের মৃত্যু হয়।

মেয়ে-জামাই ও নাতনির স্মৃতিচারণ করে মুক্তার আলম বলেন, ‘কয়দিন বাদেই ঈদ। কিন্তু আনন্দ আমাকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করছে না। বাড়িতে কারও মুখে হাসি নেই, সবাই নির্বাক হয়ে গেছে। মেহেরুনের মা জাহান আক্তার বুলবুল সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না।’

মুক্তার আলমের বাড়িও কক্সবাজারের রামু উপজেলায়। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এক ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে মেহেরুন সবার বড়। ২০১৭ সালে শাহজালালের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর প্রত্যেকবার ঈদের পরদিন মেয়ে-জামাতা মুক্তার আলমের বাড়ি বেড়াতে আসতেন। নাতনি ফায়রুজের ছোট্ট পায়ের দাপাদাপিতে ঘরজুড়ে আলো ছড়াত। বেঁচে থাকলে এবারও সবাই ঈদের পরদিন আসত– বলেই কেঁদে ফেলেন মুক্তার আলম। তিনি বলেন, যার হারায়, সেই জানে ক্ষতি। আমার পরিবারে ঈদ নেই। এবার শুধু ছোট মেয়ের জন্য থ্রিপিস কিনেছি। বাড়িতে রান্নাবান্নাও হবে না।

শাহজালালদের বাড়িতেও ঈদের আনন্দ নেই। তাঁর ভাই শাহজাহান সাজু বলেন, স্ত্রী-সন্তানসহ শাহজালালের মৃত্যুতে বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবুল কাশেম ও মা রাজিয়া বেগম অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেন না। সপ্তাহখানেক আগে চিকিৎসার জন্য চেন্নাই গেছেন। সেখানে একটি হাসপাতালে ভর্তি। আমাদের পরিবারে এবার ঈদের উৎসব বিষাদে ভরা।

দাদা ভাই কবে আসবে

গ্রিন কোজি কটেজের অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ইতালি প্রবাসী সৈয়দ মোবারক হোসেন কাউসার, তাঁর স্ত্রী স্বপ্না আক্তার, দুই মেয়ে ফাতেমা-তুজ জোহরা কাশফিয়া ও আমেনা আক্তার নুর এবং একমাত্র ছেলে সৈয়দ আব্দুল্লাহ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মোবারকের ছোট ভাই সৈয়দ আমির হামজা আলামিন বলেন, ভাতিজা আব্দুল্লাহর সমবয়সী আমার মেয়ে সৈয়দা আরমিন সুলতানা। ও আব্দুল্লাহকে দাদা ভাই বলত। মৃত্যু কী বুঝতে না পারলেও, সে এখন বেশি চুপচাপ থাকে। মাঝেমধ্যে আব্দুল্লাহর বই ধরে, সেখানে দাদা ভাইয়ের নাম দেখলেই কান্না করে। সুলতানার ধারণা, তার দাদা ভাই ফিরে আসবে। যখন জিজ্ঞেস করে কবে আসবে, কিছু বলতে পারি না। বুকটা ভেঙে যায়।

প্রতি রমজানে মোবারক ইতালি থেকে পরিবারের সদস্যদের জন্য আলাদা আলাদাভাবে টাকা পাঠাতেন। এলাকার গরিব, মহল্লার মসজিদে ইফতারি করতে টাকা দিতেন। তারাবি নামাজ পড়ানো ইমাম-মুয়াজ্জিনের জন্য টাকা পাঠাতেন। এবার এসব মানুষের মুখে ঘুরেফিরে এসেছে মোবারকের নাম। মোবারকের জন্য গ্রামবাসী এখনও কাঁদছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থানার শাহবাজপুরে গ্রামের বাইতুল নূর জামে মসজিদের সেক্রেটারি সৈয়দ শহিদুজ্জামান বলেন, মোবারক টাকা দিত বলে আমরা নির্ভার থাকতাম। এবার সত্যিই বিপাকে পড়েছি। যদিও তাঁর পরিবার সাধ্য মতো মসজিদে সহায়তা করেছে।

ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আমির হামজা। তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ে গ্রামে থাকলেও তিনি থাকতেন ঢাকায়। মোবারকের মৃত্যুর পর রাজধানীর মধুবাগ মাঠের বিপরীতে স্বপ্নচূড়া ভবনের ৩-এর বি ফ্ল্যাটে থাকছেন আমির হামজা। তিনি বলেন, বড় ভাই সৈয়দ শোয়েব হাসান স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে থাকেন ইতালি। মেজো ভাই সৈয়দ মোবারক ওই শহরে ব্যবসা করতেন। এবার পরিবার নিতে এসে সবাই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সবাইকে হারিয়ে আমাদের পরিবারে এবারের ঈদ শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। কোনো আনন্দ নেই।

লাকীর বাসাজুড়ে শুধুই নিস্তব্ধতা

বেইল রোড ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হানিয়েছেন রাজধানীর বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল প্রভাতী শাখার সিনিয়র শিক্ষক লুৎফুন্নাহার করিম লাকী, তাঁর মেয়ে জান্নাতিন তাজরী নিকিতা।

স্ত্রী-সন্তানকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন এম এ এইচ গোলাম মহিউদ্দিন খোকন। গতকাল শনিবার সার্কিট হাউস রোডের বাসায় আলাপের ফাঁকে তুলে ধরেন বিয়োগগাথা। তিনি বলেন, যে বাসায় প্রথম রোজায়ই উৎসব লেগে যেত, সেহেরি-ইফতারে কী খাওয়াবে, কার জন্য কী কিনতে হবে, তার তালিকা করত লাকী– সে বাসায় ২৭ রোজায়ও নিস্তব্ধতা। গোটা রমজানই বাসা থেকেছে বিরানভূমি। লাকীর যখন যেটা মনে ধরত কিনে আনত। হুট করে সবাইকে নিয়ে বাইরে সেহরি খেতে যেত, দূরে কোথাও ইফতার করতে যেতাম। সেসব স্মৃতি এখন চোখের সামনে ভাসে আর পাঁজর ভেঙে দেয়।

খোকন বলেন, পারিবারিক যে কোনো সমস্যা সমাধানের প্রধান চরিত্র ছিল লাকী। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী এ বাসায় এসে কথা বলে আরাম পেত। এখনও অনেকে আসছে। কিন্তু সেই উচ্ছ্বাস নেই। আমার গেছে, একমাত্র আমি বুঝতে পারছি কী হারিয়েছি।

আরও পড়ুন

×