ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সম্পাদক পরিষদের আলোচনা সভায় বক্তারা

সাংবাদিকতা সুরক্ষিত করে এমন আইন প্রণয়ন করুন

সাংবাদিকতা সুরক্ষিত  করে এমন আইন  প্রণয়ন করুন

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস-২০২৪ উপলক্ষে সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য দিচ্ছেন নোয়াব সভাপতি এ. কে. আজাদ। ছবি: সংগৃহীত

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৪ | ০০:৫০

পরিবেশগত বিপর্যয় রোধে গণমাধ্যমের বিশাল ভূমিকা থাকলেও প্রভাবশালীদের তৎপরতায় নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করে মামলারও মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। শুধু পরিবেশবিষয়ক নয়, সার্বিকভাবে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন হলেই তাদের রক্তচক্ষুর মুখোমুখি হতে হয়। এ জন্য সাংবাদিকতা সুরক্ষিত করে এমন আইন প্রণয়নের পাশাপাশি বিদ্যমান ৯টি আইন সংশোধন করে গণমাধ্যমবান্ধব করা প্রয়োজন।

গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘গ্রহের জন্য গণমাধ্যম: পরিবেশগত সংকট মোকাবিলায় সাংবাদিকতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় সম্পাদকসহ বিশিষ্টজন এসব কথা বলেন। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ এই আয়োজন করে। 

সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। বক্তব্য দেন সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সভাপতি এ. কে. আজাদ, ভোরের কাগজের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান ও দেশ রূপান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তফা মামুন।

সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক পিনাকী রায়। সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, দৈনিক সংবাদের নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার করিমসহ সাংবাদিকরা।

এতে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, ‘পরিবেশ সুরক্ষার জন্য যে সাংবাদিকতা, সেই সাংবাদিকতাকে আমরা প্রণোদনা, উৎসাহ, সমর্থন ও সুরক্ষা দিতে চাই। তবে ক্ষেত্রবিশেষে তৃণমূলে বিভিন্ন ধরনের ব্যত্যয় ঘটে।’ তিনি শুধু পরিবেশ সুরক্ষা নয়, গণমাধ্যমের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকারের সার্বিক সহযোগিতার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্র্যাটেজি উন্মুক্ত হয়ে গেলে সেটা সমস্যার। আমরা আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখব– বিশ্বের অন্যান্য ব্যাংক কীভাবে সেসব মেইনটেইন করে। আমরা তাদের আইনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করব।’

সংসদ সদস্য ও নোয়াব সভাপতি এ. কে. আজাদ বলেন, ‘দেশে গণমাধ্যমের বর্তমান অবস্থা আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পথ দিন দিন আরও নিম্নমুখী হচ্ছে। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও গোষ্ঠীর চাপে সুস্থ সাংবাদিকতার পথ ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে।’ মফস্বলে সমকালের দু’জন সাংবাদিককে সাংবাদিকতার কারণে হত্যা করা হয়েছে– এমন তথ্য তুলে ধরে এ. কে. আজাদ বলেন, ‘সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কোনো আইন নেই। সাংবাদিকদের একটি অংশ সেলফ সেন্সরশিপে চলে গিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। সাংবাদিকতা কি অপরাধ?’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে বিনা অনুমতিতে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের পদক্ষেপ ব্যাংক লোপাটকারীদেরই উৎসাহিত করবে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেশে ৯টি আইন রয়েছে, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করে। এ ছাড়া তিনটি আইনের খসড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এর পাশাপাশি প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের বিষয়টি ধরলে এমন আইনের সংখ্যা হবে ১৩। প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের খসড়া বারবার দেখতে চাওয়া সত্ত্বেও গণমাধ্যমের কাউকে দেখতে দেওয়া হয়নি।

সম্পাদক পরিষদের সহসভাপতি শ্যামল দত্ত বলেন, ‘পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সংকট পরিবেশ বিপর্যয়। বাংলাদেশে পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে হলে অনেক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। কারণ, পরিবেশ ধ্বংসকারী অনেকে গণমাধ্যমের মালিক। ঢাকার চারপাশে যারা দখলকারী, তাদের প্রায় সবারই মিডিয়া রয়েছে। আবার আইনপ্রণেতারাও পরিবেশদূষণে জড়িত। পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে হলে নানা চ্যালেঞ্জ আসে।’ 

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘গণমাধ্যমে না এলে আমরা জানতেও পারতাম না, কোথায় কী হচ্ছে। কিন্তু সাংবাদিকরা, এমনকি পরিবেশ নিয়ে রিপোর্ট করেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা খেয়েছে।’ সোমেশ্বরী নদী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই নদী একসময় খুব সুন্দর ও স্বচ্ছ ছিল। এটি ইজারা নেওয়া হয় ৮০ থেকে ৯০ কোটি টাকায়। এই নদী থেকে প্রতিদিন সাড়ে চার হাজার ট্রাক বালু তোলা হয়। তাহলে আর কী অবশিষ্ট থাকে! এটা আমরা কীভাবে বলব। কারণ সরকার তো বলবে, অনেক উন্নয়ন হচ্ছে এবং এর জন্য বালু লাগবে।

জাফর সোবহান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের অনেক কিছু করার আছে। বিশ্বব্যাপী এটি এখন বড় চ্যালেঞ্জ। মোস্তফা মামুন বলেন, ‘পরিবেশ নিয়ে আমাদের মধ্যে সচেতনতা ও আগ্রহ কম। কারণ, বিষয়টি জনপ্রিয় নয়। আবার পরিবেশ নিয়ে সাংবাদিকতা করতে হলে টেকনিক্যাল অনেক বিষয় জানতে হয়।’
মূল প্রবন্ধে পিনাকী রায় বলেন, ‘চামড়াশিল্পের জন্য বুড়িগঙ্গা নদীকে আমরা মেরে ফেলেছি। দেশে কতগুলো নদী আছে, তা-ও সরকারিভাবে স্বীকৃত নয়। অনেক নদী খাল হয়ে গেছে। সরকার নদীগুলো রক্ষা করতে পারছে না।’ 

সভাপতির বক্তব্যে দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘দেশে ৯টি আইন আছে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতায় প্রভাবিত করে। কিন্তু সাংবাদিকদের সহায়ক কোনো আইন নেই।’ পরিবেশ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করলে কোনো সাংবাদিক হয়রানির শিকার হবেন না– এমন একটা আইন অথবা সরকারি আদেশ জারি করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পরিবেশ সাংবাদিকতা করে আমরা সরকারের সহায়ক হতে চাই।’ বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকরাই ১০টি বড় আর্থিক অপরাধ তুলে ধরেছেন। এগুলোর অনুসন্ধান বাংলাদেশ ব্যাংকই করেছে। এসব অপরাধে সামগ্রিক ইমপ্যাক্ট ৩৫ হাজার কোটি টাকা। পি কে হালদার একাই ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। এর সঙ্গে কারা, কীভাবে জড়িত– তা জানা যাচ্ছে না।’ সাংবাদিকদের হয়রানি প্রসঙ্গে মাহফুজ আনাম বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চলে গেছে, কিন্তু এ আইনের ভুক্তভোগীরা এখনও জেলে। সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে এখনও ভীতিকর অনেক কিছু আছে।

 

আরও পড়ুন

×