ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

সমকালকে আজিজ মোহাম্মদ ভাই

ধরে নেন পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে আছি

ধরে নেন পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে আছি

আজিজ মোহাম্মদ ভাই। ছবি: সংগৃহীত

সাহাদাত হোসেন পরশ

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৪ | ০৮:২৪

আজিজ মোহাম্মদ ভাই– রহস্যঘেরা এক ধনকুবের। বিলাসী জীবনযাপনও তাঁকে আলাদাভাবে পরিচিতি এনে দিয়েছিল। নানা কর্মকাণ্ডের কারণে আলোচনায়ও থাকতেন সব সময়। চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় রায়ের পর ফের আলোচনায় তিনি। ২৫ বছর পর গতকাল বৃহস্পতিবার আলোচিত এ মামলার রায়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আজিজ মোহাম্মদ ভাই দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করায় তাঁর অনুপস্থিতিতেই মামলার রায় হয়েছে। পরিবার নিয়ে অনেক বছর ধরে আজিজ মোহাম্মদ থাইল্যান্ডে অবস্থান করছেন বলে আলোচনা রয়েছে। 

রায়ের পর গতকাল রাতে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমকাল। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সমকালের নানা প্রশ্নের উত্তর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই রহস্য রেখে দিলেন ‘ডন’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আজিজ।
 
প্রথমেই আজিজ মোহাম্মদ আলোচিত সোহেল চৌধুরী হত্যায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘যে হত্যাকাণ্ডের সময় আমি দেশেই ছিলাম না, সেখানে আমাকে জড়ানো হয়েছে। রায়ে ন্যায়বিচার পাইনি। কখনও সুযোগ পেলে দেশে ফিরে সত্য প্রতিষ্ঠায় লড়ব। আমি লড়তে চাই।’ 

এখন কোন দেশে অবস্থান করছেন, থাইল্যান্ডে রয়েছেন বলে সবাই জানে– এমন প্রশ্নের উত্তরও ছিল বিস্ময় মোড়ানো। আজিজ মোহাম্মদের উত্তর ছিল, ‘পৃথিবীতে থাকার মতো অনেক জায়গা রয়েছে। ধরে নেন, পৃথিবীর কোনো এক কোনা বা প্রান্তে আছি। আকাশে নেই– এটা শুধু বলতে পারি। আর থাইল্যান্ডেও আমি নেই। আমি ভালো আছি। আমার পরিবারের সবাই ভালো আছে। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’ 

এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন কিনা– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার আছে। সুযোগ থাকলে অবশ্যই আপিল করা হবে। আমি যে এ ঘটনায় জড়িত নই– আদালতে সব তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছি। যেসব অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে ২৫ বছর আগে আনা হয়েছে, তার সব মিথ্যা।’ 

১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবদিন টাওয়ারে সাততলায় ‘ট্রাম্পস ক্লাব’ নামে একটি ডিসকো ক্লাব গড়ে উঠেছিল। এটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের চাচাশ্বশুর আরেক ব্যবসায়ী বান্টি ইসলাম। ওই ট্রাম্পস ক্লাবে ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর খুন হন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী। তবে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রথম খুনের অভিযোগ ওঠে আরেক জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ মারা যাওয়ার পর। সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী অভিযোগ তোলেন, সালমানের স্ত্রী সামিরার সঙ্গে সম্পর্কের জেরে তাঁর ছেলেকে খুন করেছিলেন আজিজ মোহাম্মদ। যদিও সে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি মামলার তদন্ত সংস্থা।

১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ ও আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে বিএসইসি। শেয়ার কেলেঙ্কারির ওই মামলায় গত বছর তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছিলেন পুঁজিবাজারবিষয়ক ট্রাইব্যুনাল। ওই সময় পুলিশ আজিজ মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করে। পরে জামিন পেলে আর দেশে থাকেননি তিনি। এর পর কখনও দেশে ফিরে আসেননি। তথ্য আছে, আজিজ মোহাম্মদ পরিবার নিয়ে থাইল্যান্ডে থাকেন। তাঁর স্ত্রী নওরিন দেশে মাঝেমধ্যে এসে ব্যবসা দেখেন। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং ও সিঙ্গাপুরে আজিজ মোহাম্মদের হোটেল ও রিসোর্ট আছে।

চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদের ছিল গভীর যোগাযোগ। পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, মিডিয়া মালিক ও সাংবাদিকরা সমীহ করে চলতেন তাঁকে। ৫০টির মতো চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন আজিজ মোহাম্মদ। দেশের বিজ্ঞাপন জগতে নতুনত্ব আনতে তাঁর জুড়ি ছিল না। নিজের প্রতিষ্ঠান অলিম্পিক ব্যাটারির ‘আলো আলো বেশি আলো’ বিজ্ঞাপনে মিতা নূরকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল, তা তখন নজর কাড়ে সবার। 

১৯৪৭-এ দেশভাগের পর আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের পরিবার ভারতের কানপুর থেকে পুরান ঢাকায় থিতু হয়। তারা পারস্য বংশোদ্ভূত ‘শিয়া’ সম্প্রদায়ের লোক। আরমানিটোলায় আজিজ মোহাম্মদের জন্ম। তাঁর বাবা মোহাম্মদ ভাই ইস্পাতের ব্যবসা করতেন। এর পর ধীরে ধীরে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন তিনি। অলিম্পিক ব্যাটারি, অলিম্পিক বলপেন, অলিম্পিক ব্রেড ও বিস্কুট, এমবি ফার্মাসিউটিক্যালস, এমবি ফিল্মসহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পারিবারিক সূত্রে তিনি নিজেও ব্যবসা শুরু করেন একসময়। অল্প বয়সে বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছিলেন। গুলশানে তাঁর ছিল বিশাল বাড়ি। সেখানে নিয়মিত জমকালো পার্টি হতো।  

নব্বইয়ের দশকে একটি টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন বাংলাদেশে বেশ আলোড়ন তোলে। সেটির মডেল ছিলেন ইংরেজি দৈনিক মর্নিং সানের মালিক ববি ইসলামের মেয়ে নওরিন ইসলাম। ববি ইসলামের ভাই বান্টি ইসলাম ছিলেন আজিজ মোহাম্মদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আর বন্ধুর বাড়িতে আসা-যাওয়ার কারণেই নওরিনের সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদের পরিচয়। এর পর সেটি প্রেমের সম্পর্কে গড়ায়। শেষ পর্যন্ত পরিবার রাজি না থাকলেও আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে বিয়ে করেন নওরিন। তাদের সংসারে তিন ছেলে ও দুই  মেয়ে। এর আগে এক বিদেশি তরুণীকে বিয়ে করেন আজিজ মোহাম্মদ। 

যতদূর জানা যায়, ওই তরুণী ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক। জাতীয় পার্টির শাসনামলে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন আজিজ মোহাম্মদ। এই গ্রেপ্তার নিয়েও নানা কথা প্রচলিত। নারীঘটিত বিরোধের জের ধরেই এরশাদের সবুজ সংকেত নিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় বলে কেউ কেউ বলছেন।   

আজিজ মোহাম্মদ ভাই নিজের কর্মকাণ্ড ছাড়াও আত্মীয়স্বজনের কারণেও নানা সময় আলোচনায় আসেন। ২০০৭ সালে ইয়াবা বড়ি তৈরির জন্য তাঁর ভাতিজা আমিন হুদাকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। ২০১৩ সালে আমিন হুদার ৭৯ বছরের জেল হয়। পরে তিনি কারাগারে মারা যান। ২০১৯ সালের অক্টোবরে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের গুলশানের বাড়িতে অভিযান চালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

আরও পড়ুন

×