ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

ইসির ‘রহস্যজনক’ রায় টেকেনি আদালতে

বাতিলের পর ৭ জনই প্রার্থিতা ফিরে পান আদালতে আপিল করে

ইসির ‘রহস্যজনক’ রায় টেকেনি আদালতে

প্রতীকী ছবি

 মসিউর রহমান খান

প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৪ | ০০:৪৭ | আপডেট: ১২ জুন ২০২৪ | ১০:০২

আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পাঁচ উপজেলার সাতজনের প্রার্থিতা বাতিল করেছিল নির্বাচন কমিশন। আদালতের রায়ে সবাই ফিরে পেয়েছেন প্রার্থিতা। নির্বাচনে এই প্রার্থীদের বেশির ভাগই জয়ী হয়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে, ইসির এসব সিদ্ধান্ত যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় হয়নি। তাই আদালতে আইনি লড়াইয়ে ইসির একটি আদেশও টেকেনি। ওই প্রার্থীরা বলেছেন, ইসির সিদ্ধান্ত নির্মোহ ছিল না। এমনকি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ প্রার্থীর দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে ইসির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যোগসূত্রের কথাও বলছেন কেউ কেউ।

সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, যে কোনো মাধ্যম থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর আইনে তদন্তের কথা উল্লেখ থাকলেও ইসির কর্মকর্তারা তা আমলে নেননি। বিধিমালা অনুযায়ী প্রতিটি ঘটনার পৃথক তদন্ত হওয়ার কথা থাকলেও কোনো অভিযোগেরই তদন্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত করতে পারেনি ইসির আইন শাখা। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার পাঠানো প্রতিবেদনকেই তদন্ত প্রতিবেদন বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী জামিল হাসানের প্রার্থিতা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ‘পেছনের তারিখ দিয়ে’ একটি তদন্ত প্রতিবেদন আনা হয়েছিল। পরে আদালতের রায়ে তিনি প্রার্থিতা ফিরে পান এবং নির্বাচনে জয়ী হন। জামিল হাসানের ঘনিষ্ঠজনের অভিযোগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল করে ইসি এক ধরনের ‘সেনসেশন’ তৈরির চেষ্টা চালিয়েছে।

জামালপুরের সরিষাবাড়ী, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী ও পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাতিলে অসংগতি পাওয়া গেছে সমকালের অনুসন্ধানে। রাঙ্গাবালীর ঘটনায় প্রতিমন্ত্রীকে ক্ষমা করে দিয়ে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের প্রার্থিতা বাতিলের ঘটনায় কমিশনের দুই সদস্য ভিন্নমত পোষণ করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন তিনজন। এর মধ্যে মো. সাইদুজ্জামান মামুন জয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মোহাম্মদ রাশেদ।

সাইদুজ্জামানের সঙ্গে ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী রওশন মৃধা ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ফেরদৌসী পারভীনের প্রার্থিতাও বাতিল করেছিল ইসি। আদালতের রায়ে প্রার্থিতা ফিরে পেয়ে ফেরদৌসী পারভীন জয়লাভ করেন। রওশন মৃধা হেরে গেছেন। এ ঘটনায় দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমানের বক্তব্যে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলেও তাঁকে ক্ষমা করে দিয়ে তাঁর সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা সমকালকে বলেন, প্রতিমন্ত্রী আইন ভঙ্গ করলেও এর সুবিধাভোগী ছিলেন প্রার্থীরা।

তবে ইসির প্যানেল আইনজীবী ও সাবেক যুগ্ম সচিব ড. মোহাম্মদ শাহজাহান সমকালকে বলেন, ইসির সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়। ওই সিদ্ধান্তে যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হন, তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থেকে অনেক সময় বঞ্চিত হন। আদালত এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আদেশ দেন। ইসির সিদ্ধান্ত কম সময়ের মধ্যে নিতে হয়। তদন্তের জন্য পর্যাপ্ত সময় হাতে থাকে না।

জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে রফিকুল ইসলামের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তালেব উদ্দিন। প্রথম ধাপে ৮ মে এ নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। দু’জন সমর্থকের বক্তব্যকে আমলে নিয়ে কোনো তদন্ত ছাড়াই রফিকুলের প্রার্থিতা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। ৫ মে দেওয়া এ আদেশের বিরুদ্ধে ৬ মে রফিকুল আদালতে গিয়ে প্রার্থিতা ফিরে পান। তবে এই উপজেলার নির্বাচন স্থগিত করে দেয় কমিশন। একই সঙ্গে ইসির পক্ষ থেকে ওই আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে আপিল করা হয়। তবে ইসির আপিলের বিষয়ে সাড়া দেননি (নো অর্ডার) আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। এরপর ইসি আপিল বিভাগে আবেদন করে। তখন আদালত মৌখিক আদেশে ভোট বন্ধ না রেখে দ্রুত নির্বাচন শেষ করার তাগিদ দেন। নির্বাচনে জয়ী হন রফিকুল। 

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. রিয়াজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে তাঁর অনুপস্থিতিতে কর্মী-সমর্থকের আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়। তিনি আদালতের রায়ে প্রার্থিতা ফিরে পেলেও নির্বাচনে হেরে যান। 

আচরণবিধিতে বলা আছে, কোনো উৎস থেকে বা লিখিত রিপোর্টের মাধ্যমে পাওয়া তথ্যে কমিশনের কাছে যদি মনে হয়, কোনো প্রার্থীর আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণে নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হতে পারেন, তাহলে তাৎক্ষণিক তদন্তের নির্দেশ দিতে পারবেন। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর কমিশন অভিযোগের বিষয়ে সন্তুষ্ট হলে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানার মতে, তদন্ত করতে পারবেন মানে তদন্ত করতে ইসি বাধ্য নন। প্রয়োজন মনে করলে করবেন, না মনে হলে করবেন না। সরিষাবাড়ী উপজেলার ভোট নিয়ে ইসি আইনি লড়াইয়ে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত গেলেও অন্যগুলোর ক্ষেত্রে একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়নি কেন– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সব ঘটনায় সমান আচরণ করা যায় না।’

আরও পড়ুন

×