সুইজারল্যান্ডের পরিবর্তে এখন অর্থ পাচারের গন্তব্য অন্য জায়গায়
২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের জমা কমেছে ৬৮ শতাংশ

ছবি-সংগৃহীত
জাকির হোসেন
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৪ | ০০:৪৮ | আপডেট: ২১ জুন ২০২৪ | ০৭:৫৩
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের আমানত কমেছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের নামে থাকা অর্থের পরিমাণও কমেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে ২০২৩ সালে তাদের দেশের ব্যাংকগুলোর দায় ও সম্পদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।
প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৩ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশের পাওনা রয়েছে ১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ফ্রাঁ ১৩২ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ২৩৪ কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে বাংলাদেশের কাছে সুইজারল্যান্ডের দায় ছিল ৫ কোটি ৫২ লাখ সুইস ফ্রাঁ। এ হিসাবে কমেছে ৬৮ শতাংশ।
২০২২ সালেও সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের নামে থাকা অর্থের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে যায়। এর আগ পর্যন্ত কয়েক বছর বাংলাদেশের কাছে সুইস ব্যাংকগুলোতে বড় অঙ্কের দায় ছিল। ২০২১ সালে যার পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। গত দুই বছর বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার সংকট সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক ব্যবস্থায় তাদের জমা থাকা অর্থের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণ বলে মনে করা হয়।
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে ২০২২ সাল শেষে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের জমার পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৫৬ লাখ ৪৫ হাজার ফ্রাঁ। গত বছর শেষে তা ১ কোটি ৪০ লাখ ফ্রাঁ-তে নেমেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ১৮৫ কোটি টাকা। এদিকে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পাওনা মাত্র ৩৫ লাখ ফ্রাঁ। ২০২২ সাল শেষে যা ছিল ১ কোটি ৯৩ লাখ ফ্রাঁ। ২০২১ সালে ছিল ৮৪ কোটি ফ্রাঁ।
এদিকে সম্পদ ব্যবস্থাপকের মাধ্যমে বিভিন্ন শেয়ার বা সিকিউরিটিজে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ বেড়েছে। গত বছর এ ধরনের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৮৭ লাখ ফ্রাঁ বা ১১৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ। আগের বছর ছিল ৩১ লাখ ফ্রাঁ।
সুইস ব্যাংকে থাকা অর্থের একটি অংশ পাচার হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়। তবে পাচার সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না; এমনকি গ্রাহক আমানত হিসাবে কার কত অর্থ আছে তাও জানা যায় না। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গোপনীয়তার স্বার্থে সব ডাটা সমন্বিতভাবে প্রকাশ করে। আলাদাভাবে কোনো গ্রাহক বা ব্যাংকের তথ্য এ প্রতিবেদনে নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সাবেক প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান সমকালকে বলেন, মূলত আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের কারণে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন হয়। গত দুই বছরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে স্থিতি অনেক কমে এসেছে। তাঁর মতে, বাংলাদেশ থেকে যারা অর্থ পাচার করেন, তারা এখন আর সুইস ব্যাংকমুখী নন। কেননা সুইস ব্যাংকগুলো নিয়মকানুন কড়া করেছে। মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগের নামে অবৈধ অর্থ রাখার সুযোগ রয়েছে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো চুক্তি রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই দেশের আর্থিক গোয়েন্দাদের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের সুযোগ রয়েছে। ভারত যেমন কর ফাঁকির অর্থ ফেরত আনতে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি করেছে, বাংলাদেশের তেমন চুক্তি নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু সুইজারল্যান্ড নয়, সারাবিশ্বেই বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে স্থিতি কমে গেছে। কেননা, বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে রয়েছে। আমদানি ও ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়ে যাওয়ায় সুইস ব্যাংকগুলো থেকে বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি অনেক কমে গেছে।
এদিকে সুইস ব্যাংকে ভারত ও পাকিস্তানের নামে থাকা অর্থও আগের বছরের চেয়ে কমেছে। ভারতের নামে রয়েছে ১০৩ কোটি ফ্রাঁ। ২০২২ সাল শেষে ছিল ৩৪০ কোটি ফ্রাঁ এবং ২০২১ সালে ছিল ৩৮৩ কোটি ফ্রাঁ। অন্যদিকে পাকিস্তানের কাছে সুইস ব্যাংকগুলোর দায় ২৯ কোটি ফ্রাঁ। এর আগের বছর ছিল ৩৯ কোটি ফ্রাঁ। ২০২১ সালে ছিল ৭১ কোটি ফ্রাঁ।
বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান যদি নিজের বদলে অন্য দেশের নামে অর্থ গচ্ছিত রেখে থাকে, তাহলে তা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের নামে থাকা পরিসংখ্যানের মধ্যে আসেনি। একইভাবে সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা মূল্যবান শিল্পকর্ম, স্বর্ণ বা দুর্লভ সামগ্রীর আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অনেক দেশের নাগরিকই মূল্যবান সামগ্রী সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকের ভল্টে রেখে থাকেন।
কয়েক বছর ধরে সুইজারল্যান্ড বার্ষিক ব্যাংকিং পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে। বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বা বিএফআইইউ সুইজারল্যান্ডের একই ধরনের এফআইইউর সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগও করেছিল। কিন্তু ব্যক্তির তালিকা সংবলিত কোনো তথ্য তারা দেয়নি। সুইজারল্যান্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অবৈধভাবে কেউ অর্থ নিয়ে গেছে– এমন প্রমাণ সরবরাহ করলে তারা তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে।
২০১৭ সালে এ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে জানান, বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে যে লেনদেন হয়, তা মূলত অর্থ পাচার নয়। তবে সামান্য অর্থ পাচার হয়।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করে। সংস্থাটি বাণিজ্যের আড়ালে কোন দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, তার প্রাক্কলন করে। জিএফআইর প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বছরে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক জোট আইসিআইজে ২০১৩ সালে বিভিন্ন দেশে কোম্পানি খুলেছে– এমন ৩২ জন বাংলাদেশির নাম প্রকাশ করে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত আইসিআইজের পানামা পেপারস ডাটাবেজে ৫৬ জন বাংলাদেশির নাম ছিল, যারা করের স্বর্গ বলে পরিচিত বিভিন্ন দেশে কোম্পানির নিবন্ধন নিয়েছেন। ২০১৭ সালে প্যারাডাইস পেপারসে ২১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায়। ২০১৮ সালে একই পেপারসের সংযোজনীতে ২২ বাংলাদেশির নাম পাওয়া যায়। কর ফাঁকি দিতে, অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ গোপন করতে, কোম্পানির মুনাফা লুকাতে, পরিবারের সদস্যদের উন্নত জীবনযাপন ও আবাসনের ব্যবস্থা করতে এবং অন্যান্য কারণে অর্থ পাচার হয়ে থাকে।