রাতদিন বিক্রি চলে প্রকাশ্যে
ফাতেমার বাড়িতে ইয়াবা হেরোইনের ‘ দোকান’
১২ বছরে তিন বাড়ির মালিক

ফাতেমা বেগম
বকুল আহমেদ
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪ | ০০:৩৭
রাজধানীর পল্লবীর বাউনিয়া বাঁধের ফাতেমা বেগমের (ফতু) বাবা বাবুল হোসেন ছিলেন চিহ্নিত মাদক কারবারি। বাবুল মারা যাওয়ার পর ফাতেমা, তাঁর দুই বোন, দুই ভাই ও তাদের স্ত্রী জড়িয়ে পড়েন মাদক কারবারিতে। ইয়াবা, হেরোইন ও গাঁজা বিক্রি করে বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় তিনটি বাড়ির মালিক হয়েছেন ফাতেমা। বাড়ির সামনে একটি ফ্ল্যাট বন্ধক নিয়ে খুলেছেন দোকান, যেখানে প্রকাশ্যে বিক্রি হয় ইয়াবা, হেরোইন ও গাঁজা।
৪০ বছরের ফাতেমা ২৫ বছর ধরে মাদক কারবারে জড়িত। বাবার সঙ্গে প্রথমে বাংলা মদ বিক্রি করতেন। এর পর গাঁজা বিক্রি শুরু করেন; এখন গাঁজার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইয়াবা ও হেরোইন। এসব বিক্রির জন্য লোক নিয়োগ দিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি বাউনিয়া বাঁধের বি ব্লকে গিয়ে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রির দৃশ্য দেখা যায়। লালমাটিয়ার টেম্পুস্ট্যান্ড থেকে কালশীর দিকে ৫০-৬০ গজ হাঁটলে ডান পাশে একটি গলি। এই গলির বাঁ-পাশে ৬ নম্বর আর ডান পাশে ৭ নম্বর লাইন। ৬ নম্বর লাইনের ২০ নম্বর হোল্ডিংয়ের তিনতলা বাড়ির প্রধান দরজার সামনে কয়েক কিশোর-তরুণের জটলা চোখে পড়ে। কাছে গিয়ে দেখা যায়, দরজার ওপাশ থেকে এক যুবক কাগজে মুড়িয়ে গাঁজা, হেরোইন ও ইয়াবা তুলে দিচ্ছেন তাদের হাতে। ওই কিশোর-তরুণরা লাইন ধরে সেগুলো কিনছেন। ১৫ মিনিটে এভাবে প্রায় ৩০ জনকে মাদক কিনতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে দু’জন আট পিস ইয়াবা কেনেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক তরুণ বলেন, ‘যে কোনো সময় এলেই এখানে ইয়াবা পাওয়া যায়।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফ্ল্যাটটি প্রায় দুই বছর আগে জয়নাল উদ্দিনের কাছ থেকে বন্ধক নিয়েছেন মাদক কারবারি ফাতেমা। পরে সেটিকে তিনি ইয়াবা, হেরোইন ও গাঁজার ‘দোকান’ বানান। এই ফ্ল্যাটের সামনে ফাতেমার নিজের বাড়ির নিচতলায়ও মাদক বিক্রি হয়। সেখানে মাদক নিয়ে বসে থাকেন তাঁর নিয়োগ করা লোকজন।
মাদকের এই বেচাকেনা প্রকাশ্যে চললেও প্রতিবাদ করতে পারেন না এলাকাবাসী। কারণ, প্রতিবাদ করলেই হামলার শিকার হতে হয়। স্থানীয়রা জানান, ফাতেমা সবাইকে ‘ম্যানেজ’ করে বছরের পর বছর মাদক বিক্রি করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে যাওয়ার পর আবার মাদক বেচাকেনা শুরু করেন।
এলাকাবাসী জানায়, ফাতেমা ছাড়াও বাবুল হোসেনের দুই ছেলে মামুন হোসেন ও খোকন হোসেন এবং অপর দুই মেয়ে মাদক কারবারে জড়িত। ফাতেমার দুই ভাবিও ইয়াবা-হেরোইনের ব্যবসা করেন। বছর ১২ আগে বাবুল হোসেন মারা যাওয়ার পর পরিবারটির সবাই মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ে।
ফাতেমার স্বামীর নাম মো. খোকন। স্বামী-স্ত্রী মিলে তারা বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন। পুলিশ জানায়, ফাতেমার নামে দেড় ডজন ও তাঁর স্বামীর নামে অর্ধডজন মাদক মামলা রয়েছে পল্লবীসহ রাজধানীর বিভিন্ন থানায়। তারা গ্রেপ্তারও হয়েছেন একাধিকবার। কিন্তু খুব বেশিদিন জেলখানায় ছিলেন না, জামিনে বেরিয়ে আবার মাদক ব্যবসা শুরু করেন।
ফাতেমার পুরো পরিবার মাদক কারবারে জড়িত থাকার বিষয়টি পুলিশের জানা। পল্লবী থানার ওসি অপূর্ব হাসান সমকালকে বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে ৬৮টি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে বেরিয়ে তারা একই কাজ শুরু করেন।’
সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মহানগর উত্তর বিভাগের একটি দল ফাতেমার বন্ধক নেওয়া বাসায় অভিযান চালায়। এ সময় তাঁর ‘সেলসম্যান’ আলামিন শেখকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাসায় পাওয়া যায় ২০০ পিস ইয়াবা ও ২০০ গ্রাম গাঁজা। তবে ফাতেমা দম্পতিকে পাওয়া যায়নি।
ফাতেমা মাদক বিক্রির জন্য ছয়জনকে নিয়োগ দিয়েছেন বলে জানা যায়। তাদের কাউকে বিক্রির ওপর কমিশন, আবার কাউকে দৈনিক হিসাবে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়।
বাবা বাবুল হোসেন মারা যাওয়ার পর মাদকের কারবার করে ফাতেমা বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় তিনটি বাড়ি করেছেন বলে জানান স্থানীয়রা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বি ব্লকের ৭ নম্বর লাইনের ৪ নম্বর বাড়ির মালিক ফাতেমা। চার তলা এই বাড়ির দোতলা পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে। এটি ভাড়া দেওয়া আছে। একটি বাড়ির পর ২ নম্বর হোল্ডিংয়ের তিনতলা বাড়ির মালিকও ফাতেমা। এই বাড়িতে তিনি থাকেন। একই লাইনে ৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের বাড়িটিও তাঁর। ইটের দেয়ালের ওপর টিনের ছাউনি দেওয়া এই বাড়িটিও ভাড়া দিয়েছেন ফাতেমা। এ ছাড়া ৬ নম্বর লেনের একটি জায়গা দখল করে টিনশেড ঘর তোলার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এলাকাবাসী বলছেন, তিনটি বাড়ি ছাড়াও অন্য এলাকায় ফাতেমার বিপুল সম্পদ রয়েছে, যার ঠিকানা তারা জানেন না।
এসব বিষয়ে কথা বলতে সম্প্রতি একাধিক দিন ফাতেমার বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানান, মাদক কারবারি এই পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে থাকেন কম। এলাকায় হঠাৎ তাদের দেখা যায়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ সমকালকে বলেন, ‘মাদক বিক্রির টাকায় সম্পদ গড়ার তথ্য পেলে আমরা অনুসন্ধান করব। প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
- বিষয় :
- মাদক ব্যবসায়ী